ছদ্মবেশে কয়েক দিন ঘুর ঘুরের পর সুযোগ বুঝে দোতলায় উঠে পরিকল্পিত হত্যারই অংশ হিসেবে বুকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত
জীবননগর ব্যুরো: ঘাতকের ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত জীবননগরের সাংবাদিক আবু সায়েম (৩৫) মারা গেছেন। দীর্ঘ ১৬ ঘণ্টা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে গতকাল বুধবার বিকেলে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকা বক্ষব্যাধি হাসপাতালের আইসিইউতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার খবর জীবননগরসহ চুয়াডাঙ্গার সাংবাদিকদের মাঝে ছড়িয়ে পড়লে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। অপরদিকে খুনি রাজিবকে পুলিশ গ্রেফতার করে। সে দর্শনা ঈশ্বরচন্দ্রপুর গ্রামের মতিয়ার রহমানের ছেলে। সে কেন ছুরিকাঘাতে সাংবাদিক সায়েমকে খুন করেছে তা বলেনি। পুলিশ তাকে নেশাখোর বলে আখ্যা দিলে সাংবাদিকদের মাঝে নতুন করে নানা প্রশ্ন দানা বাধে।
পারিবারেক সূত্র জানায়, দৈনিক সমকালের জীবননগর প্রতিনিধি আবু সায়েম অন্য দিনের মতো রাতে জীবননগর পিয়ারাতলাস্থ বাড়ির দ্বিতীয়তলায় শয়নকক্ষে প্রবেশ করে। রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঘাতক রাজিব বাড়ির পেছনে সিঁড়ির রুমে লাগানো বাঁশের মই দিয়ে দোতলায় ওঠে। সিঁড়ির গ্রিলবিহীন স্কাই লাইট দিয়ে সে ভেতরে ঢোকে। সায়েমের স্ত্রী বাথরুম থেকে বের হতেই একজনকে বালিশ বুকে জড়িয়ে সায়েমের ঘরের অদূরে অবস্থান করছে দেখে চমকে উঠে চিৎকার দিয়ে ওঠেন। স্ত্রীর চিৎকারে ঘর থেকে বের হন সাংবাদিক আবু সায়েম। ঘাতক ছুটে গিয়ে সাংবাদিক আবু সায়েমের বুকে বুকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করতে থাকে। শুরু হয় ধস্তাধস্তি। সায়েমের আত্মচিৎকারে এ সময় তার পিতা আবুল খায়ের ওরফে বাচ্চু মোল্লা (৬৫) লাঠি নিয়ে উপরে এসে ঘাতক রাজিবকে পেটাতে থাকেন। ঘাতক রাজিব এ সময় আবু সায়েমের পিতার কপালে ছুরি দিয়ে আঘাত করে জখম করে পালিয়ে যায়। পালিয়ে যাওয়াকালে সায়েমের মা আমেনা খাতুন ঘাতকের উদ্দেশে বলে ‘তোর কালও মুরগির গোস্ত দিয়ে ভাত খেতে দিয়েছিলাম আর আজ তুই এ কি করলি’। এদিকে মারাত্মক আহত অবস্থায় আবু সায়েমকে জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হয়। কিন্তু বুকের ক্ষতের গভীরতা দেখে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন। এখানে তার অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় সায়েমকে ঢাকা বক্ষব্যাধি হাসপাতালে রেফার করা হয়। রাতেই সায়েমকে ঢাকার উদ্দেশে নেয়া হয় এবং গতকাল বুধবার তাকে ঢাকা বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দুপুরে শুরু করা হয় অস্ত্রোপচার। অস্ত্রোপচারের পর রাখা হয় আইসিইউতে। বিকেল ৪টার দিকে সাংবাদিক আবু সায়েম মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এদিকে ছুরিকাঘাতে সাংবাদিক আবু সায়েম ও তার পিতাকে আহত করার পর ঘাতক রাজিব রক্তমাখা ছুরি ও মাথায় থাকা লাল সালু ফেলে পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে তল্লাশি করে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরি ও লাল সালু উদ্ধারসহ ঘাতককে ধরতে অভিযান শুরু করে। রাত সাড়ে ৩টার দিকে প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় এসআই শতদল মজুমদার ফোর্স নিয়ে ঘাতক রাজিবকে মনোহরপুর শিমুলতলা থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পূর্বে সে মনোহরপুরে তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে রক্তমাখা কাপড় ধুয়ে পরিস্কার করে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
প্রতিবেশী সূত্র আরো জানা যায়, উপজেলা জাসদের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক আবু সায়েমের পিতা বাচ্চু মোল্লা মারফত তন্ত্রের মানুষ। কয়েক দিন আগে অপরিচিত ঘাতক রাজিব মারফতি ফকির তন্ত্রের বেশ ধরে সায়েমদের বাড়িতে আসে। পরিত্যক্ত একটি ঘরে অবস্থান নেয়। ভাত চেয়ে খায়। কয়েক দিন ধরে আবু সায়েমের বাড়ির আশপাশে ঘুর ঘুর করতে থাকে। সুযোগ বুঝে গতপরশু মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে একবার দোতলায় উঠেছিলো। এই সময় সায়েম বাড়ি ছিলো না। সায়েমের স্ত্রী তাকে দেখে ফেলে এবং উপরে ওঠার কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে উত্তর না দিয়ে নেমে যায়। পরে আবার সে কখন উপরে ওঠে তা কেউ বুঝতে পারেনি। দোতলার একটি ঘরে দু সন্তানের পাশে শুয়ে পড়ে সায়েম। স্ত্রী দোতলার সৌচাগারে যান। সেখান থেকে ফেরার সময় বাথরুমের সামনের ডায়নিং স্পেসের পাশে বালিশ বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চিৎকার করেন সায়েমের স্ত্রী। স্ত্রীর চিৎকারে ঘর থেকে বের হতেই সয়েমের বুকে একের পর এক ছুরিকাঘাত করতে থাকে ঘাতক রাজিব। সায়েমের স্ত্রীর চিৎকারে নিচ থেকে লাঠি নিয়ে উঠে আসেন সায়েমের পিতা। তিনি লাঠি দিয়ে ঘাতককে মারপিট শুরু করেন। ঘাতককে আটকাতে সায়েমের মা দরজা দিতে গেলে সায়েম ধাক্কা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে সিঁড়ির মাঝে। যেদিক দিয়ে সে ঢুকেছে সেদিক দিয়েই বেরিয়ে সটকে পড়ে।
এদিকে এ হত্যাকাণ্ডে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন জীবননগর উপজেলা আওয়ামী সভাপতি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান গোলাম মোর্তুজা, জীবননগর উপজেলা লোকমোর্চার সভাপতি আবুল কালাম আজাদ ও সাধারণ সম্পাদক উপজেলা চেয়ারম্যান আবু মো. আ. লতিফ অমল। জীবনগর উপজেলা প্রশাসনের সকল দপ্তরে দুপুরে ১ ঘণ্টার কলম বিরতি পালন করার ঘোষণা দিয়েছে। দৈনিক সমকাল আজ থেকে তিন দিনের শোক ঘোষণা করে কালোব্যাজ ধারণ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাব ও সাংবাদিক সমিতি যৌথভাগে গতরাত ৮টায় প্রেসক্লাবে প্রতিবাদসভা করেছে। এছাড়া আলমডাঙ্গা, দামুড়হুদা, দর্শনা প্রেসক্লাব প্রতিবাদসভা করে হত্যার রহস্য উন্মোচনের দাবি জানিয়েছে। এছাড়াও সরোজগঞ্জ সাংবাদিক ইউনিটও প্রতিবাদ সভা করেছে।
নিহত আবু সায়েমের পরিচয়: জীবননগর উপজেলার উথলী ইউনিয়নের আবুল খায়ের ওরফে বাচ্চু মোল্লার দু ছেলে ও দু মেয়ের মধ্যে আবু সায়েম ছোট। এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার পর তিনি সিঙ্গাপুর প্রবাসী হন। দীর্ঘদিন প্রবাস জীবন শেষে ২০০৬ সালের দিকে সে দেশে ফেরেন। এ সময় জাসদের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। ২০০৭ সালের দিকে সে বাংলাদেশ সময় নামক দৈনিক পত্রিকার জীবননগর প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ পেয়ে সাংবাদিকতা শুরু করেন। গত বছরের শেষের দিকে আবু সায়েম দৈনিক সমকালে প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ পান এবং সম্প্রতি তিনি জীবননগর উপজেলা সাংবাদিক কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন। সাংবাদিক সায়েম সাংবাদিকতার পাশাপাশি শহরের কাজি টাউয়ারে অ্যাপেক্স জুতোর শোরুম ব্যবসার পাশাপাশি পিয়ারাতলাতে চাতাল ব্যবসা পরিচালনা কর আসছিলেন। সম্প্রতি তিনি কাজি টাউয়ার থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে মোল্লা মার্কেটে ব্যবসা করে আসছিলেন। আবু সায়েম দু ছেলের জনক। তার বড় ছেলে ৭ বছরের রুদ্র আকলিমা প্রি-ক্যাডেট স্কুলের কেজি ও ছোট ছেলে রনক নার্সারি শ্রেণির ছাত্র। সায়েমের স্ত্রী রেশমা খাতুন রক্স প্রকল্পের স্কুলে শিক্ষকতা করেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা শিশু দু সন্তান তাদের প্রিয় পিতাকে হারালো।