ফরিদপুর চাঁপাইনবাবগঞ্জ মাগুরা শেরপুর সুনামগঞ্জ কুষ্টিয়া বরগুনা ও চাঁদপুর জেলার নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠকে শেথ হাসিনা
স্টাফ রিপোর্টার: প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দল যাকে মনোনয়ন দেবে তাকে বিজয়ী করতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার জন্য দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তবে তিনি এও বলেছেন, কর্মী বিচ্ছিন্ন কাউকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়া হবে না। তৃণমূল নেতাদের মতামত এবং বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত জরিপ পর্যালোচনা করেই বিজয়ী হতে পারবেন এমন নেতাদেরই মনোনয়ন দেয়া হবে।
গতকাল বুধবার গণভবনে আওয়ামী লীগের আটটি জেলার তৃণমূল নেতাদের সাথে রুদ্ধদ্বার মতবিনিময় বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। মহাজোগগতভাবেই আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়ার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, মহাজোটগতভাবেই আমরা নির্বাচন করবো। কিন্তু সর্বাগ্রে আমরা দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করতে চাই। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বলিয়ান হয়ে নৌকা মার্কাকে বিজয়ী করার জন্য তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানান। এর আগে বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামে হেফাজত নেতা মুফতি ইজহারুলের মাদরাসায় ভয়াবহ গ্রেনেড ও বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, আমাদের বিরোধীদলীয় নেত্রী (খালেদা জিয়া) এখন কী জবাব দেবেন? এই হেফাজত ও জামায়াত-শিবিরকে সোথে নিয়ে তিনি (খালেদা জিয়া) গ্রেনেড-বোমা হামলা করে ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করতে চান। ক্ষমতা দখল করে উনি দেশকে যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজত্ব সৃষ্টি করতে চান। একই সাথে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির অস্তিত্ব ধ্বংস করতে চান। এদের ব্যাপারে দেশবাসীকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।
আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এরা যদি ক্ষমতায় আসে বাংলাদেশের অবস্থা কী হবে, কী ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে- তা একটু চিন্তা করে দেখার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আর যাতে ভবিষ্যতে এসব সন্ত্রাসী, জঙ্গীবাদ অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সেজন্য দেশবাসীকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দেশের স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন, অগ্রগতি ও মানুষের শান্তি আমাদের বিরোধী দলের নেতার সহ্য হচ্ছে না বলে তিনি দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিয়ে মানুষের শান্তি বিনষ্ট করতে চান উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, চট্টগ্রামের ওই হেফাজত নেতার মাদরাসায় তৈরির সময় গ্রেনেড ও বোমার বিষ্ফোরণ না ঘটলে জানাই যেতো না সেখানে কী মারণাস্ত্র তৈরি হচ্ছিলো। দেশকে ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে কী যে ষড়যন্ত্র চলছে। আর এই হেফাজতকে সমর্থন দিচ্ছেন খালেদা জিয়া। বিরোধী দলের নেতার প্রতি প্রশ্ন রেখে প্রধানমন্ত্রী বলেন, হেফাজত ও জামায়াত-শিবিরকে সাথে নিয়ে গত ৪ ও ৫ মে ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকারকে উত্খাত করে আপনি দেশকে কোথায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন? দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে কী করতে চেয়েছিলেন?
বিএনপি-জামায়াত ও হেফাজতের তাণ্ডব তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিরোধীদলীয় নেত্রীকে আমি সংলাপের আহ্বান জানালাম। আর উনি (খালেদা জিয়া) আমাকে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে বললেন, আমি নাকি পালানোরও পথ খুঁজে পাবো না। আমার প্রশ্ন, কীসের ওপর ভরসা করে উনি এমন কথা বলেছেন? তিনি বলেন, হুমকি দেয়ার পরদিনই উনি নির্দেশ দিয়ে বিএনপি-জামায়াত ও হেফাজতকে দিয়ে ঢাকা শহরে তাণ্ডব চালালেন। মসজিদে আগুন দিয়ে শ শ কোরআন শরিফ পুড়িয়ে দিলেন। তিনি বলেন, জামায়াত ইসলামের নামে রাজনীতি করে আর বিএনপি নাকি ইসলামের সুরক্ষা করে। এটাই কী তার নমুনা? যারা মসজিদে আগুন দেয়, শ শ পবিত্র কোরআন শরিফ পুড়িয়ে দেয় তারা কীভাবে ইসলামের হেফাজতকারী হয়? এরা কীভাবে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী হতে পারে? প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণের জানমালের রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব। তারা যেভাবে মসজিদে আগুন, ব্যাংক-বীমা, সরকারি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে, মানুষ মেরেছে তখন কী সরকার চেয়ে চেয়ে দেখবে? তিনি বলেন, এ ঘটনার পর বিরোধী দলের নেতা অপপ্রচার শুরু করলেন যে, আমরা নাকি হাজার হাজার মানুষকে মেরে ফেলেছি, দেড় লাখেরও বেশি গুলিবর্ষণ করেছি! দেড় লাখ গুলিবর্ষণ করা হলে তো মতিঝিলের একটি দালান-কোঠা অক্ষত থাকার কথা নয়। আমরা চ্যালেঞ্জ করে নাম-ঠিকানা চাইলে অধিকার নামের একটি এনজিও’র মাধ্যমে যে ৬১ জনের তালিকা দেয়া হলো, তার মধ্যে বেশ ক’জন জীবিত অবস্থায় লেখাপড়া করছে। আর অনেকের নামও ভুয়া। আসলে জনগণের সাথে ভাওতাবাজি করে বিভ্রান্ত করা আর মিথ্যাচার করাই বিএনপির নেত্রীর চরিত্র। তিনি বলেন, ওইদিন জামায়াত-হেফাজতকে নিয়ে নৈরাজ্য চালিয়ে দেশের শান্তি বিনষ্ট এবং ক্ষমতা দখল করে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করার চেষ্টা হয়েছিলো।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিরোধীদলের নেতা এর আগে ক্ষমতায় থাকতে যুদ্ধাপরাধীদের শুধু পুনর্বাসনই নয়, মন্ত্রী জানিয়ে তাদের গাড়িতে রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছিলেন। এখন যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় এই হেফাজত-জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে গ্রেনেড-বোমার মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করার ষড়যন্ত্র করছেন। দেশবাসীকে মনে রাখতে হবে, এরা ক্ষমতায় আসলে দেশ আবারও জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিণত হবে। যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজত্ব সৃষ্টি হবে। দেশে আবারও একদিনে সারাদেশের ৫শ’ স্থানে বোমার হামলার ঘটনা ঘটবে। দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে এরা যেন আর স্বাধীন দেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ক্ষমতায় আসার পর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ শুরু করেছি। এই বিচার শুরুর পর থেকেই আমাদের বিরোধী দলীয় নেত্রী প্রায় প্রতিদিনই আমাদের হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন, সারাদেশে পরিকল্পিত নৈরাজ্য চালাচ্ছেন। আন্দোলনের নামে ঘুমন্ত ড্রাইভারের গায়ে আগুণ দিয়ে পুড়িয়ে মারছেন, পুলিশ-বিজিবি ও সেনা সদস্যেদের হত্যা করছেন। দেশকে অস্থিতিশীল ও দেশের উন্নয়নকে ব্যাহত করতে হেন কাজ নেই যা তিনি (খালেদা জিয়া) করছেন না। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পাঁচ বছরের নিপীড়ন-দুঃশাসনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ওই পাঁচটি বছরই বাংলাদেশকে ওরা একটি কারাগারে পরিণত করেছিল। দেশকে সবদিক থেকে একডিট ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে নিয়ে গিয়েছিল। ওই পাঁচটি বছরই বাংলাদেশ ছিল সন্ত্রাসী, জঙ্গীবাদ ও দুর্নীতির অভয়ারণ্যে। দেশের এমন কোনো পেশার মানুষ নেই যারা ওই সময় নির্যাতনের শিকার হননি। একাত্তরের পাকিস্তানের হানাদারবাহিনীর মতোই তারা পাঁচটি বছর দেশের মানুষকে নির্যাতন করেছে। দেশকে পাঁচ পাঁচবার দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করেছে। তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় হাওয়া ভবন খুলে মানুষের সম্পদ লুণ্ঠন করা হয়েছিল। কোন ব্যবসায়ী হাওয়া ভবনের পাওনা না মিটিয়ে কোন কাজ করতে পারেনি।
সংবিধান সংশোধন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনর্প্রতিষ্ঠা করে হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দীর্ঘ এক বছর ধরে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত করার পাশাপাশি আর যাতে বাংলাদেশে অসাংবিধানিক পন্থায় কেউ ক্ষমতা দখল করতে না পারে- সংবিধানে সেটিও নিশ্চিত করেছি। জনগণের ভোটাধিকার তাদের হাতে ফিরিয়ে দিয়েছি। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ধারা নিশ্চিত করেছি।
প্রধানমন্ত্রী গতকাল বুধবার ফরিদপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মাগুরা, শেরপুর, সুনামগঞ্জ, কুষ্টিয়া, বরগুনা ও চাঁদপুর জেলার তৃণমূল নেতারা মতবিনিময় বৈঠকে অংশ নেন। প্রধানমন্ত্রীর সূচনা বক্তব্যের পর তার সভাপতিত্বে তৃণমূল নেতাদের সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের শুরুতেই সরবরাহকৃত একটি ফরম পূরণ করার মাধ্যমে তৃণমূল নেতারা আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নে স্ব স্ব এলাকার তিনজন করে প্রার্থীর নাম প্রস্তাব করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেন। বৈঠক শুরুর পর বিকেল পাঁচটায় এক ঘণটার জন্য সংসদে অংশগ্রহণের জন্য মুলতবি করেন প্রধানমন্ত্রী। সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নিয়ে ফের গণভবনে গিয়ে তৃণমূল নেতাদের সাথে দীর্ঘরাত অবধি বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী। বৈঠকে কয়েকটি জেলার তৃণমূল নেতারা বেশ কয়েকজন মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে ধরে প্রার্থী মনোনয়নে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য আহ্বান জানান।
বৈঠকে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, বেগম মতিয়া চৌধুরী, কাজী জাফর উল্যাহ, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, অধ্যাপক ড. আলাউদ্দিন আহমেদ, মাহবুব-উল-আলম হানিফ, ডা. দীপু মনি, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, আবদুর রহমান, আফম বাহাউদ্দিন নাছিম, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, মৃণাল কান্তি দাস প্রমুখ।