সাগরে হাজার হাজার বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা : আরো ১৪১৮ বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা উদ্ধার

মাথাভাঙ্গা মনিটর: মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সমুদ্র উপকূলে মানবপাচারকারীদের চারটি নৌযান থেকে গতকাল সোমবার মোট ১৪১৮ জন বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা অবৈধ অভিবাসীকে উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে একশ জনের বেশি নারী ও শিশু রয়েছে। এর আগে গত রোববার ইন্দোনেশিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় আচেহ্ প্রদেশের সমুদ্র উপকূলের একটি নৌযান থেকে প্রায় ৬শ বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা অভিবাসীকে উদ্ধার করা হয়। আচেহ্ প্রদেশের উপকূল থেকে উদ্ধারকৃতদের মধ্যে মোহাম্মদ কাশিম নামে এক বাংলাদেশি জানিয়েছেন, মালয়েশিয়ায় চাকরির উদ্দেশে প্রায় এক মাস আগে বাড়ি ছেড়েছেন তিনি। পথে তার তিন সঙ্গীর মৃত্যু হয়েছে।

মিয়ানমার ও বাংলাদেশের এক হাজারের বেশি অবৈধ অভিবাসীকে মালয়েশিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় পর্যটন দ্বীপ লাংকাওয়ীতে অবৈধভাবে আসার জন্য গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৫৫৫ জন বাংলাদেশি ও ৪৬৩ জন রোহিঙ্গা। ৯৯ জন নারী ও ৫৪ শিশু রয়েছে। মানব পাচারকারীরা এই অভিবাসীদের লাংকাওয়ীর উপকূলে ফেলে চলে গেছে। লাংকাওয়ীর উপ-পুলিশ প্রধান জামিল আহমেদ বিবিসিকে বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, তিনটি নৌযানে এক হাজার ১৮ জন অভিবাসী ছিলেন। তাদেরকে অভিবাসন বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হবে। জামিল জানান, এক বাংলাদেশি যাত্রী তাকে বলেছেন, নৌকার চালকদের মালয়েশিয়া যাওয়ার নির্দেশনা দিয়ে অন্য নৌকায় করে পালিয়ে গেছেন। গত তিন দিনে তারা কিছুই খায়নি। এসব অভিবাসীদের অনেকেই অসুস্থ। অভিবাসীদের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে জানান তিনি।

এক খবরে বলা হয়েছে গতকাল সোমবার সকালে ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের উপকূলে একটি নৌকা থেকে পুরুষ, নারী ও শিশুসহ ৪০০ অবৈধ অভিবাসীকে উদ্ধার করেছে কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে দুই দিনে প্রায় এক হাজার অবৈধ অভিবাসীকে উদ্ধার করা হলো। আচেহ’র প্রাদেশিক উদ্ধার ও অনুসন্ধান বিভাগের প্রধান বুদিওয়ান বলেন, খুব ভোরে উত্তর আচেহ্র উপকূলে একটি নৌযান থেকে অনুসন্ধান ও উদ্ধার দল অভিবাসীদের উদ্ধার করে। তিনি জানান, ইন্দোনেশিয়ার দূরবর্তী পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশের উপকূলে টহলে সহায়তার জন্য মত্স্যজীবীদের নিয়োগ করা হয়েছে। সংকেত পাওয়া মাত্র অভিবাসীদের উদ্ধারে আমরা প্রস্তুত রয়েছি।

খবরে বলা হয়, সম্প্রতি মিয়ানমার থেকে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) বলছে, সম্প্রতি থাইল্যান্ডে মানব পাচারকারীদের ক্যাম্প ও গণকবর আবিষ্কারের পর কর্তৃপক্ষ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। অভিযান শুরুর পর পাচারকারীরা অভিবাসীদের গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার পরিবর্তে নৌযানে রেখেই পালিয়ে যাচ্ছে। থাইল্যান্ডের কাছে সমুদ্রে সাত-আট হাজার বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা অভিবাসী আটকে রয়েছে। সংস্থাটির একজন মুখপাত্র বিবিসিকে বলেন, থাই নিরাপত্তারক্ষীদের তত্পরতা বেড়ে যাওয়ায় পাচারকারীরা নৌকাগুলো তীরে ভিড়াতে চাইছে না।

ইন্দোনেশিয়ার আচেহ্ প্রদেশের লকসুকন শহরের একটি জিমনেসিয়ামে এনে রাখা হয়েছে উদ্ধারকৃত রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিদের। সেখানে তাদের খাবার ও প্রয়োজনীয় চিকিত্সার ব্যবস্থা করেছে কর্তৃপক্ষ। জিমনেসিয়ামে অবস্থানরত অভিবাসীদের মধ্যে রয়েছেন মোহাম্মাদ কাশিম নামে এক বাংলাদেশি। তিনি বলেন, মালয়েশিয়ায় আসার জন্য পাচারকারীদের ৪ হাজার ৪শ রিঙ্গিত বা ১২শ’ ডলার করে দিয়েছে যাত্রীরা। কিন্তু তাদের মালয়েশিয়ায় পৌঁছে দেয়া হয়নি। তিনি জানান, যাত্রাপথে তিন আরোহীর মৃত্যু হয়েছে। তাদের মরদেহ সাগরে ফেলে দিয়েছে পাচারকারীরা।

৪৪ বছর বয়সী কাশিমের বাড়ি বগুড়া জেলায়। তিনি প্রায় এক মাস আগে মালয়েশিয়ায় ভালো কাজের আশায় একটি ছোট নৌকায় ৩০ থেকে ৪০ জনের সঙ্গে যাত্রা করেন। এ যাত্রার সব বন্দোবস্ত করে বগুড়ার একটি এজেন্সি। তিনি বলেন, ১৬ বছর বয়সে আমি একবার মালয়েশিয়ায় গিয়ে নির্মাণ প্রকল্পে তিন বছর কাজ করেছিলাম। বাংলাদেশে কাজ পাওয়া কঠিন হওয়ায় আমি আবারো মালয়েশিয়ায় আসার চেষ্টা করি। বগুড়া ছাড়ার পর আমাদেরকে নৌকায় করে থাইল্যান্ডের একটি উপকূলে আনা হয়। বড় নৌযানে শ শ যাত্রীর সঙ্গে যাত্রার আগে আমরা ঐ উপকূলে ২১ দিন অবস্থান করি। এরপর সেখান থেকে ইন্দোনেশিয়ার উপকূলে এসে পৌঁছেছি।

রাশিদ আহমেদ নামে ৪৩ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা বলেন, আমাদের জন্য কোন খাবার ছিল না। তিন মাস আগে তিনি তার ছেলেকে নিয়ে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য ছেড়ে আসেন বলে জানান।

গত এক সপ্তাহে থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলীয় সংখলা প্রদেশের গভীর জঙ্গলে পাচারকারীদের ক্যাম্প ও গণকবর আবিষ্কারের পর এখন পর্যন্ত ৩৩ জনের মরদেহ পাওয়া গেছে। এছাড়া জঙ্গল থেকে প্রায় একশো জনের মতো অভিবাসীকে আটক করা হয়েছে। থাইল্যান্ডে গণকবর আবিষ্কারের পর মানব পাচার চক্র নির্মূলের নির্দেশ দিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী প্রয়ুথ চ্যান-ওচা। অন্যদিকে, থাইল্যান্ডের সংখলা প্রদেশের এক মেয়র ও এক সাবেক এমপিকে মানব পাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া মানব পাচার বন্ধে একসঙ্গে কাজ করতে আগামী শুক্রবার আলোচনায় বসছে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার পুলিশ কর্মকর্তারা। সম্প্রতি জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার হিসাব অনুযায়ী চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে ২৫ হাজারের মতো অভিবাসী নৌকায় করে অবৈধভাবে দেশ ছেড়ে গেছে। এদের মধ্যে প্রায় ৩শ’ জনের মৃত্যু হয়েছে।

জাতিসংঘের অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা আইওএম জানিয়েছে মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের কয়েক হাজার অবৈধ অভিবাসী থাইল্যান্ড উপকূলের কাছে সাগরে অপেক্ষা করছে। সংস্থার একজন মুখপাত্র বলেছেন, থাই নিরাপত্তা রক্ষীদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় পাচারকারীরা নৌকাগুলো তীরে ভেড়াতে চাইছে না। গভীর জঙ্গলে গোপর শিবিরে না এনে পাচারকারীরা এখন অভিবাসীদের সাগরের বুকে রাখছে।

সাগরে আটকে পড়া অভিবাসীদের সংখ্যা আট হাজারের মত হতে পারে।
মালয়েশিয়ায় নেমেছে এক হাজার মালয়েশিয়ার পুলিশ জানিয়েছে, আজ (সোমবার) উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের লাংকাওয়ী দ্বীপে নৌকায় করে এক হাজারেরও বেশি অভিবাসী এসে নেমেছে। গভীর রাতে তিনটি নৌকায় এদেরকে এনে তীরে নামিয়ে দেওয়া হয়। লাংকাওয়ীর পুলিশ কর্মকর্তা জামিল আহমেদ বিবিসিকে বলেন, মোট ১০১৮ জন অভিবাসীর মধ্যে ৫৫৫ জন বাংলাদেশী এবং ৪৬৩ জন মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম। অভিবাসীদের মধ্যে পঞ্চাশটিরও বেশি শিশু এবং প্রায় একশ’র মত মহিলা রয়েছে।

ইন্দোনেশিয়ায় ১০০০ উদ্ধার ইন্দোনেশিয়ায় পুলিশ জানিয়েছে, সোমবার সকালে আচে প্রদেশের উপকুলের কাছে একটি নৌকা থেকে চারশো’র মত অভিবাসীকে উদ্ধার করা হয়েছে।
এ নিয়ে গত দুদিনে ইন্দোনেশিয়া তাদের উপকূল থেকে এক হাজারের মত বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছে। রোববার উদ্ধার হওয়া ৬০০ লোককে আঁচের একটি ফুটবল স্টেডিয়ামে নিয়ে রাখা হয়েছে। তারা পুলিশকে জানিয়েছে, তীরে নামার আগে তাদের নৌকাগুলো সপ্তাহখানেক ধরে সাগরে ভাসছিল। তাদের খাবার ফুরিয়ে গিয়েছিল। জাতসংঘ শরণার্থী সংস্থার হিসাবে, এব বছরের প্রথম তিন মাসে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে ২৫,০০০ এর মত অভিবাসী নৌকায় করে অবৈধভাবে মূলত: মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে রওয়ানা হয়।

Leave a comment