মানবপাচাররোধে কঠোর হওয়া প্রয়োজন

 

মানব পাচার পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম একটি অপরাধ। অথচ দরিদ্র দেশগুলো থেকে প্রতি বছরই মানব পাচার হচ্ছে অবাধে। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনার মধ্যদিয়ে আবারো বাংলাদেশ থেকে মানব পাচারের বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছে। সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া কিংবা অন্য কোনো দেশে পাঠানোর নাম করে প্রতি বছর কতো সংখ্যক বেকার তরুণকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যানও বোধ করি কারো কাছে নেই। বাংলাদেশের প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো যা-ই বলুক না কেন, এ অবৈধ ব্যবসা যে দিনদিনই ফুলেফেঁপে উঠছে, তা বলাইবাহুল্য। সম্প্রতি থাইল্যান্ডের জঙ্গল থেকে অবৈধভাবে পাচার হয়ে যাওয়া যে ১১৭ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে, তার ৯১ জনই বাংলাদেশি নাগরিক। বিষয়টি গভীর উদ্বেগ এবং আতঙ্কের বলেই প্রতীয়মান হয়। জাতিসংঘের সর্বশেষ তথ্য থেকেও জানা যাচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই ২৫ হাজার বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা মানব পাচারের শিকার হয়েছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এ সংখ্যা দ্বিগুণ। এদের মধ্যে এ বছরের প্রথম তিন মাসে মারা গেছে ৩শ জন। আর গত বছরের অক্টোবর থেকে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬২০ জনে। যাদের বেশিরভাগই মারা গেছে ক্ষুধা-তৃষ্ণা ও নির্যাতনে। কয়েকদিন আগে থাইল্যান্ডের জঙ্গলের গণকবরে যে ৩২টি মৃতদেহ পাওয়া যায়, সেগুলোও বাংলাদেশিদের বলে গণমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়েছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনেও এটা নিশ্চিত করা হয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের তরুণদের এটাই কি নিয়তি! আরো উদ্বেগের বিষয় যে, মালয়েশিয়ার জঙ্গলে এ রকম বহু গণকবর থাকতে পারে বলেও আশঙ্কা করছে সে দেশের সরকার এবং বিশেষজ্ঞরা। ফলে বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতেই সরকারের বিবেচনায় নেয়া সঙ্গত। বাংলাদেশ থেকে অবৈধ উপায়ে ও পথে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা পুরোনো। অতীতে বহুবার ঘটেছে এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা। অনেকে অবৈধ উপায়ে বিদেশে যেতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে। এছাড়া যাওয়ার পথে সমুদ্রে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা তো রয়েছেই। এর আগে থাই জঙ্গল থেকে ১৩০ জন বাংলাদেশি উদ্ধার হওয়ার পর জানা যায়, ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রির জন্য এসব বাংলাদেশিকে ওই জঙ্গলে রাখা হয়। এদের ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখানো হয়েছিলো। এবারো উদ্ধার হওয়া নাগরিকদের যে একই কায়দায় বা প্রলোভনে অবৈধ পথে ওই জঙ্গলে রাখা হয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আমাদের বিস্ময়ের সীমা থাকে না যখন, মানব পাচারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন প্রণয়ন করা হলেও মানব পাচার রোধ করা যাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সমুদ্রে কোস্টগার্ডের সতর্ক নজরদারি থাকা সত্ত্বেও কিভাবে বাংলাদেশি নাগরিক পাচার হতে পারে সে বিষয়টি রাষ্ট্রকে অবিলম্বে খতিয়ে দেখতে হবে। জনবহুল বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের সিংহভাগই এখন অর্জিত হচ্ছে বিদেশে জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে। সেখানে অবৈধভাবে জনশক্তি পাচার হলে এবং তাদের জীবনে অন্ধকার নেমে এলে এর চেয়ে পরিতাপের বিষয় আর কী হতে পারে! অবৈধ পন্থায় বিদেশ গমনে প্রলোভন দেখানো বা মানব পাচার শুধু দেশের ভাবমূর্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে না, বৈধ উপায়ে বিদেশে গমনকারীদের জন্যও তা হয়ে উঠছে ঝুঁকিপূর্ণ। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণে এমনটি মনে করা অস্বাভাবিক নয়। নতুন স্বপ্নের খোঁজে, বেকারত্ব নিরসনে তরুণ ও যুবকরা বিদেশে যাবেন এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু তা হতে হবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি অনুযায়ী, সঠিক পন্থায়। সরকার যে এ ব্যাপারে আন্তরিক, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হলো, অবৈধ পন্থায় বিদেশ গমন কেন রোধ হবে না। প্রসঙ্গত বলতে চাই, মানব পাচার শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়, এটি যেমন আন্তর্জাতিক তেমনি আঞ্চলিক সমস্যাও। গণমাধ্যমের তথ্যমতে, মানব পাচার রোধে যৌথ কার্যক্রম গ্রহণের লক্ষ্যে থাইল্যান্ড সরকার ত্রিদেশীয় বৈঠক আহ্বান করেছে। অন্য দুটি দেশ হলো মালয়েশিয়া ও মিয়ানমার। বাংলাদেশও সেই উদ্যোগের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে। এছাড়া সম্প্রতি উদ্ধার হওয়া নাগরিকদেরও দেশে ফিরিয়ে আনার যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। পাশাপাশি মানব পাচারের সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদ্যোগ নিতে হবে। যে কোনো মূল্যে এই ভয়ঙ্কর প্রবণতা রোধ হোক এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

Leave a comment