নেপালে পরিবহন ভাড়া ও পণ্যের দাম দ্বিগুণ

মাথাভাঙ্গা মনিটর: হিমালয়কন্যা খ্যাত নেপাল ভূমিকম্পে তার রূপ অনেকাংশ হারিয়ে ফেলেছে। একই সঙ্গে হারিয়েছে মন্দির, পুরনো রাজা-রানীর ভবনসহ ঐতিহাসিক অনেক নিদর্শন। পর্যটন দেশ হিসেবে পরিচিত নেপালে যেখানে পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড় থাকত সর্বদা, সেখানে এখন চোখে পড়ছে না অল্পসংখ্যক পর্যটকও। ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির। যানবাহনের ভাড়া আকাশছোঁয়া। একই সঙ্গে খাদ্যসামগ্রী, রড, সিমেন্ট, ইটসহ ভবন নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। অধিকাংশ ইটভাটার চুল্লি ভূমিকম্পে ভেঙে পড়েছে। মজুদ ইটও নষ্ট হয়ে গেছে। দেশটির সরকার বিশেষ বিশেষ স্থাপনাগুলোর ধ্বংসাবশেষ উদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলোকে কাঠ, লোহার সাহায্যে ঠেকিয়ে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলো রক্ষায় কাজ করছে আর্মি ও পুলিশ। জাতিসংঘের একটি সমীক্ষা অনুসারে, নেপালে শুধু উদ্ধারকাজ সম্পন্ন করতে ৪১ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার প্রয়োজন। এখনও উদ্ধারকাজ শেষ হয়নি। বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার দ্বারা সমীক্ষা শুরু করলেও পুনরায় স্থাপন ও ফাটল ধরা ভবনগুলো মেরামতে কী পরিমাণ অথের্র প্রয়োজন তা প্রাথমিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। শিক্ষার্থীদের মধ্যে চরম আতংক থাকায় প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। এখনও প্রায় ৩ মিলিয়ন লোক খাদ্য সমস্যায় ভুগছেন। ১ লাখ ৬০ হাজার ভবনসহ ছোট-বড় প্রায় আরও ৫০ হাজার স্থাপনা ভেগে গেছে।

রাজধানী কাঠমাণ্ডুতে প্রায় আড়াই হাজার আবাসিক হোটেলের অধিকাংশই বন্ধ রয়েছে। যেগুলো চালু রয়েছে তাতেও বর্ডার মিলছে না। একই সঙ্গে হাজার হাজার রেস্টুরেন্ট বন্ধ রয়েছে। যে কয়টি খোলা রয়েছে তাতে কাস্টমার দেখা যাচ্ছে না। কাঠমান্ডুতে থাকা প্রায় ৮০ লাখ লোকের মধ্যে বর্তমানে প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ লোক রয়েছে। ভারত-বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের লোকজন ইতিমধ্যে স্ব স্ব দেশে ফিরে গেছেন। যারা রয়েছেন তারা ব্যবসা-বাণিজ্য ও শ্রমে মনোযোগ দিতে পারছেন না। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কাঠমান্ডু শহরে এবং আশপাশে প্রায় দেড় লাখ বিউটি পার্লার ও স্পা বন্ধ রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক ও মালিকরা শহর ছেড়ে যাওয়ায় সেগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। বাংলাদেশী ব্যবসায়ী এতেহশামুল হক সামেল জানান, নেপালে স্কাইলার্ক আবাসিক হোটেল ও এনবিএস রেস্টরেন্টে স্বত্বাধিকারী তিনি। শুধু তার রেস্টুরেন্টই নয়, কাঠমান্ডুর প্রায় সব কটি রেস্টুরেন্ট এখন যেন মানবশূন্য। অপর ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশ নেপাল সোসাইটির সেক্রটারি সাদাফ রহমান জানান, যেসব রেস্টুরেন্টে দিনে লাখ লাখ টাকা বিক্রি হতো সেসব রেস্টুরেন্টে এখন কোনো বিক্রিই হচ্ছে না।

কাঠমান্ডু থামেল এলাকার বিউটি পার্লার ব্যবসায়ী ভিমন কুমার জানান, শহরে শত শত মেয়ে-ছেলে এখানকার পার্লার ও স্পা-তে কাজ করতেন। ভূমিকম্পের পরদিন থেকে ভয়-আতংকে প্রায় সবাই চলে গেছেন। একই অবস্থা হোটেল ও রেস্টুরেন্টগুলোর।

শহরের বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, শাকসবজির দাম দ্বিগুণ। যে টমেটো ভূমিকম্পের আগে ৪০ টাকা কেজি ছিল তা বর্তমানে ৮০ থেকে ৯০ টাকা। মাছের দাম দ্বিগুণ বেড়েছে। একই সঙ্গে ব্রলার মুরগি কেজিপ্রতি ৫০ থেকে ৬০ টাকা বেড়েছে।

সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, নেপালে যানবাহনের ভাড়া ২ থেকে ৩-৪ গুণ বেড়েছে। ট্যাক্সির ভাড়া যেখানে শহরের ভেতর ২-৩ রুপি ছিল, ভূমিকম্পের পর তা ৪০০ থেকে ১০০০ রুপি হয়েছে। কারণ হিসেবে যানবাহন ড্রাইভাররা বলছেন, শহরে নেই পর্যাপ্ত গাড়ি, হেলপার ও চালক। তাই যে পরিমাণ গাড়ি শহরে চলছে তা যথেষ্ট নয়। গাড়ির জ্বালানিও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ভাড়া বেশি রাখতে হচ্ছে। নেপালে ৭৫টি জেলার মধ্যে ৩৭টি জেলায় ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। এসব জেলায় ভেঙে পড়া ভবনগুলো সংস্কারের প্রয়োজনীয় সামগ্রী এ মুহূর্তে দেশটিতে নেই।

লতিলপুর জেলার পাটন দরবার স্কোয়ার এলাকার রড-সিমেন্ট ব্যবসায়ী হারিবানা জানান, ভূমিকম্পের ১৩ দিন পর তিনি তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলেছেন। তবে পর্যাপ্ত নির্মাণসামগ্রী নেই। অনেকেই আসছেন ইট-সিমেন্ট ও রড নিতে। তিনি বলেন, ইট হাজারপ্রতি ২-৩ হাজার রুপি বেড়েছে এবং বেড়েছে রড-সিমেন্টের দামও। খানিকটা দূরেই কেপিসি সিমেন্ট কোম্পানির ম্যানেজার রমেশ নেপাল জানান, আসলে এখনও নির্মাণকাজ শুরু হয়নি, উদ্ধারকাজই চলছে। বাসাবাড়ির লোকজন বাড়ি মেরামত করতে চাইলেও প্রশাসনের নিষেধ থাকায় কাজ ধরতে পারছেন না। কিছুদিন পরই পর্যাপ্ত পরিমাণ সিমেন্ট প্রয়োজন হবে। এ জন্য তিনি মজুদ রাখার চেষ্টা করছেন।

নেপালের সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, যেসব স্থাপনা ভেঙে পড়েছে সেসব স্থাপনায় নির্মাণকাজ শুরু করতে আরও অনেক দিন লাগবে। এখনও উদ্ধারকাজ শেষ হয়নি। নেপাল সরকারের তরফ থেকে ভূমিকম্পের পরপরই জানিয়ে দেয়া হয়েছে ভূমিকম্পের কারণে কোনো জিনিসপত্রের দাম যেন বাড়ানো না হয়। প্রবাসী নেপালিরা উদ্ধারকাজ ও নির্মাণের জন্য অর্থ পাঠাচ্ছেন বলে জানা গেছে। স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছ থেকে জানা গেছে, প্রবাসী নেপালিরা একত্রিত হয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। বিভিন্ন দেশ থেকে তারা অর্থ পাঠাচ্ছেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে ভোররাত পর্যন্ত কাঠমান্ডুসহ যেসব এলাকায় ভূমিকম্পে লোকজন নিহত ও আহত হয়েছেন তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় আলো প্রজ্বালন করা হয়। এদিকে শুক্রবার নেপালে তিনবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে।

Leave a comment