দর্শনা আকন্দবাড়িয়ায় কেরুজ জৈব সার–কারখানা উদ্বোধন অনুষ্ঠানে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু
হারুন রাজু/নজরুল ইসলাম: দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্ববৃহৎ, এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহতম জেলার একমাত্র ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান ঐতিহ্যবাহী কেরুজ চিনিকল। এ চিনিকলটির আরো একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বাড়লো। কেরুজ চিনিকলের আওতায় উদ্বোধন করা হলো জৈব সার-কারখানা। দীর্ঘদিন পরীক্ষামূলকভাবে সার উৎপাদন কার্যক্রম শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে জৈব সার কারখানার উদ্বোধন করলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু এমপি। গতকাল ১৭ এপ্রিল ঐহিতাসিক মুজিবনগর দিবসের সমাবেশ শেষে শিল্পমন্ত্রী দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে গাড়িবহরযোগে কেরুজ অতিথি ভবনে পৌঁছান। অতিথি ভবন চত্বরে শিল্পমন্ত্রীকে রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শন করা হয়। গতকাল শুক্রবার বিকেল ৪টায় কারখানা প্রাঙ্গণে ফলক উন্মোচন ও দোয়া-মোনাজাতের মাধ্যমে এ জৈব সার-কারখানার উদ্বোধন করেন মন্ত্রী। এর ফলে এখন থেকে দর্শনা কেরু চিনিকলের আকন্দবাড়িয়া বীজ উৎপাদন খামারে নির্মিত এ সার-কারখানাটি বাণিজ্যিকভাবে যাত্রা শুরু করার দ্বার খুলে গেলো।
সার-কারখানায় অনুষ্ঠিত উদ্বোধন সমাবেশে প্রধান অতিথি ও উদ্বোধক শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, চিনিকলের বর্জ্য থেকে তৈরি পরিবেশবান্ধব এ জৈব সার দেশের কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। চিনিকলের যে বর্জ্য পরিবেশ দূষণ করে তার থেকে রেহাই হবে। এর ফলে একদিকে পরিবেশ দূষণ যেমন বন্ধ হবে, অন্যদিকে জমির ঊর্বরতাও বৃদ্ধিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে।
বর্তমানে প্রতিবছর সরকারকে ২২ লাখ মেট্টিক টন রাসায়নিক সার আমদানি করতে হয়। এ সমস্ত জৈব সার-কারখানা স্থাপনের ফলে বিদেশ থেকে রাসায়নিক সার আমদানি অনেকাংশে কমে আসবে। ফলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। তিনি আরও বলেন, যুগ যুগ ধরে চাষিকূল আমাদের অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে সমৃদ্ধ করেছে। কৃষিবান্ধব এ সরকার কৃষকের সকল সুবিধা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। বিগত দিনে যারা ক্ষমতায় এসেছিলো, তারা কখনো ভাবেনি এ দেশের কৃষকের কথা, ভাবেনি শ্রমিকের কথা, ভাবেনি দেশের মেহনতি মানুষের কথা। তারা দেশের সম্পদ নষ্ট করে নিজের আখের গুছিয়েছে। তারাই দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছিলো। বন্ধ করে দিয়েছিলো দেশের অনেক শিল্প কলকারখানা। বেকার করেছিলো বহু শ্রমিক-কর্মচারীকে। তাই দেশের মানুষ ওদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলার স্থপতি, বাঙালি জাতির মুক্তিদাতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি সমৃদ্ধশীল সোনার বাংলাদেশ। সমৃদ্ধশীল সোনার বাংলা গড়তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাজ করছেন নিরলসভাবে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশে বেকারত্ম ঘুচাতে বর্তমান সরকার দেশের মৃত ও রুগ্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো পুনরুদ্ধার করে তা সচল করেছে। সেই সাথে শিল্প কারখানাগুলো আধুনিয়কায়ন করা হয়েছে। বাড়ানো হচ্ছে শিল্প কলকারখানা। আগামীতে এ উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে আসুন সকল অনিয়ম, দুর্নীতিকে মোকাবেলা করে বাংলাদেশকে একটি শিল্প সমৃদ্ধশীল দেশ হিসেবে গড়ে তুলি। সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের সকল কর্মচারী-কর্মকর্তাকে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে মনোযোগী হতে হবে।
শিল্পমন্ত্রী আরো বলেন, কোনো প্রকার দুর্নীতি অনিয়ম বরদাস্ত করা হবে। কেরুজ চিনিকলের বাণিজ্যিক খামারের জমি লিজসহ বিভিন্ন অনিময়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে এ সরকার। বাংলাদেশ এখন স্বয়ং সম্পন্ন একটি দেশ। এ দেশে এখন নেই খাদ্য ঘাটতি। আমরা দেশের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছি। আমি বিশ্বাস করি কেরুজ এ জৈব সার-কারখানা এলাকার চাষিদের চাহিদা পূরণ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জাতীয় সংসদের হুইপ চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য, জেলা আ.লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন বলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা আ.লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যখন বিগত সরকারের রেখে যাওয়া জঞ্জাল সরিয়ে দেশকে এগিয়ে যাচ্ছে সমৃদ্ধির পথে, ঠিক তখনই ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য একটি মহল উঠে পড়ে লেগেছে। আমরা সকল বাধা শক্ত হাতে মোকাবেলা করে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখেছি। বিগত সরকার দেশের মানুষকে ঠকিয়ে নিজেদের আখের গুছাতে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছে। তাই জনগণ পরপর দু’বার তাদের উচিত জবাব দিয়েছে। কেরুজ চিনিকল থেকে সরকার প্রতি বছর প্রচুর রাজস্ব পেয়ে থাকে। মিলের লাভজনক প্রতিষ্ঠান ডিস্টিলারি বিভাগ। সেই ডিস্টিলারি ভবনটির ভয়ানক অবস্থা। তাই ডিস্টিলারি ভবন নির্মাণের জন্য শিল্পমন্ত্রীর কাছে দাবি করেছেন হুইপ ছেলুন জোয়ার্দ্দার। চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সংসদ সদস্য জেলা আ.লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক হাজি আলী আজগার টগর বলেন, দেশের মানুষ এখন শান্তিতে আছে। শান্তিপ্রিয় বাঙালি শান্তিতে থাকতে চায় বলেই আবারো আ.লীগকে ক্ষমতার সিংহাসনে বসিয়েছে। তাই আসুন দেশ, জাতি তথা সমাজের উন্নয়নে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে প্রত্যয়ী হই। শিল্প সমৃদ্ধশীল বাংলাদেশ গড়তে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো টিকিয়ে রাখতে হবে। কেরুজ চিনিকল এ এলাকাকে আলোকিত করে রেখেছে। আরো একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে জৈব সার-কারখানায় সার উৎপাদন কার্যক্রমের মধ্যদিয়ে আরেক ধাপ এগিয়ে গেলো কেরুজ চিনিকল। এ অঞ্চলের অন্যতম অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি এ মিলটিকে বাঁচিয়ে কর্মকর্তা ও শ্রমিক-কর্মচারীদের হতে হবে সৎ ও নিষ্ঠাবান। কেরুজ চিনিকলকে আরো বেশি লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে মিনারেল ওয়াটারসহ দুটি বিভাগের অনুমোদনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রণেনের জন্য শিল্পমন্ত্রীর কাছে দাবি করেছেন এমপি আলী আজগার টগর।
কেরুজ চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাজি এবিএম আরশাদ হোসেনের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন- বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান একেএম দেলোয়ার হোসেন। উপস্থিত ছিলেন- করপোরেশনের পরিচালক (উৎপাদন ও প্রকৌশলী) আমিনুল হক, সচিব আবদার হোসেন, চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক মো. দেলোয়ার হোসাইন, জেলা পরিষদ প্রশাসক দামুড়হুদা উপজেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান মঞ্জু, জেলা পুলিশ সুপার রশীদুল হাসান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গোলাম বেনজির আহমেদ, চুয়াডাঙ্গা জেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক দামুড়হুদা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আজাদুল ইসলাম আজাদ, চুয়াডাঙ্গা পৌর মেয়র রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটন, দামুড়হুদা উপজেলা আ.লীগের সভাপতি সিরাজুল আলম ঝন্টু, যুগ্মসম্পাদক ইউপি চেয়ারম্যান জাকারিয়া আলম, জীবননগর উপজেলা চেয়ারম্যান আ. লতিফ অমল, ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজুল ইসলাম, আয়েশা সুলতানা লাকী, সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম মর্তুজা, দর্শনা পৌর আ.লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম, কেরুজ চিনিকলের মহাব্যবস্থাপক (কৃষি) মোস্তফা কামাল, মহাব্যবস্থাপক (অর্থ) মোশারফ হোসেন, মহাব্যবস্থাপক (ডিস্টিলারি) আব্দুল কুদ্দুস, মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মনোয়ার হোসেন, জৈব সার-কারখানার ইনচার্জ সাখাওয়াত হোসেন, ডিস্টিলারি সেলস অফিসার শেখ শাহবুদ্দিন, কেরুজ শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি তৈয়ব আলী, সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান মাসুদ, সাবেক সভাপতি হাফিজুল ইসলাম, শ্রমিক নেতা ফিরোজ আহম্মেদ সবুজ, ফারুক আহেম্মদ, জয়নাল আবেদীন, আ.লীগ নেতা সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান হাজি শহিদুল ইসলাম, আলী মুনসুর বাবু, আখচাষি নেতা হাজি আকমত আলী, আব্দুল হান্নান, আ. বারী, ওমর আলী প্রমুখ। গিয়াস উদ্দিনের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী সভায় বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান একেএম দেলোয়ার হোসেন ও কেরুজ চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের পক্ষ থেকে সভাপতি তৈয়ব আলী এবং সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুকে সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান করেন।। উদ্বোধন অনুষ্ঠান শেষে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে গাড়িবহরযোগে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু।
উল্লেখ্য, কেরুজ চিনিকল কর্তৃপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে জৈব সার-কারখানা প্রতিষ্ঠার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় ৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা। চিনিকলের দর্শনার পার্শ্ববর্তী আকন্দবাড়িয়া বীজ উৎপাদন খামারের নিজস্ব জমির ওপর সার-কারখানা নির্মান কাজ শুরু করা হয়। চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের সার্বিক সহযোগিতায় দ্রুত নির্মান কাজ সম্পন্ন করে ভারতের টরিও চিম টেকনো লিগাল সার্ভিস প্রাইভেট লিমিটেডের কারিগরি সহায়তায় মেশিনারিজ স্থাপনের কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়। গত বছরের মে মাসে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করা হয় আকন্দবাড়িয়ার সার-কারখানায়। এ কারখানায় বছরে ৯ হাজার মেট্রিক টন সার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে করপোরেশন। এ সার তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে চিনি কারখানার উপজাত প্রেসমাড এবং ডিস্টিলারি কারখানার বর্জ পেন্টাওয়াস। কাঁচামাল হিসেবে প্রতিবছর ১৮ হাজার মেট্রিক টন প্রেসমাড ও ৪০ হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য পেন্টওয়াস ব্যবহার করা হতে পারে। কেরুজ চিনিকল থেকেই প্রেসমার্ড পাওয়া যাবে ২ হাজার মেট্রিক টন, বাকি প্রেসমাড দেশের অন্যান্য চিনি কারখানা থেকে সংগ্রহ করতে হবে। এ দুটি বর্জ্য সার-কারখানায় কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে অ্যারোবিক কম্পোসটিং পদ্ধতিতে পরিবেশ বান্ধব জৈব সার উৎপাদন করা হচ্ছে। ইতঃপূর্বে এ বর্জ পরিবেশ দূষণের কারণে ফেলা দেয়া হতো মাথাভাঙ্গা নদীতে। এ সার রসায়নিক সারের পরিবর্তে ব্যবহারে চাষিকূল লাভবান হবে। এতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমবে। সাশ্রয়ী হবে বৈদিশিক মুদ্রা। কেরুজ উৎপাদিত জৈব সার ব্যবহারে মাটির ঊর্বরতা ও উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, দূর করবে মাটির বিষাক্ততা। সর্বোপুরি জৈব সার ফসলের গুণগত মান বৃদ্ধিতে দারুণ সহায়ক হবে। এরই মধ্যে কেরুজ উৎপাদিত সার বাজারজাতকরণ, মূল্য নির্ধারণ ও গুণগতমান পরীক্ষার অনুমোদনের জন্য প্রক্রিয়া চলছে। এ সার কারখানা পরিপূর্ণভাবে চালু হলে একদিকে যেমন পরিবেশ দূষণ রোধ হবে, অন্যদিকে কেরুজ চিনিকলের স্পেন্ট ওয়াসের কারণে মাথাভাঙ্গা নদীর পানি দূষিত হবে না। জৈব সার কারখানা প্রতিষ্ঠায় প্রায় সাড়ে ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে হয়েছে। অবশেষে স্বপ্ন পূরণের পথে কেরুজ চিনিকল কর্তৃপক্ষ ও এলাকাবাসীর।