নির্বাচন নিয়ে বিএনপির ওপর নাখোশ জামায়াত

স্টাফ রিপোর্টার: সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে প্রার্থিতা চূড়ান্ত করা নিয়ে বিএনপির ওপর নাখোশ তাদের অন্যতম প্রধান শরিক দল জামায়াতে ইসলামী। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে নতুন করে টানাপোড়েন ও দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের অভিযোগ- নির্বাচনসংক্রান্ত কোনো প্রক্রিয়ার সাথেই জামায়াতকে অন্তর্ভুক্ত করেনি বিএনপি। এমনকি তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই বিএনপি তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

জামায়াত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে শেষ পর্যন্ত বিএনপির সিটি নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত মেনে নেয় জামায়াত। কিন্তু বিপত্তি দেখা দিয়েছে জোটগতভাবে কাউন্সিলর প্রার্থী দেয়া নিয়ে। ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াত এখনও সমঝোতার ভিত্তিতে কাউন্সিলর প্রার্থী দিতে পারেনি। নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে এলেও এখন পর্যন্ত তারা এ ইস্যুতে সমঝোতায় পৌঁছতে পারেনি। তিন সিটির অনেক ওয়ার্ডেই বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতেরও কাউন্সিলর প্রার্থী রয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে কোনো ধরনের আপসরফা না হওয়ায় বিএনপির ওপর নাখোশ জামায়াতের নেতাকর্মীরা।

জামায়াত তিন সিটিতে মেয়র প্রার্থী না দিলেও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী এম মনজুর আলম তাদের পছন্দের তালিকায় রয়েছেন। আগের নির্বাচনেও এম মনজুর আলমকে জয়ী করতে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। এছাড়া ঢাকা দক্ষিণের মেয়র প্রার্থী মির্জা আব্বাস ও উত্তরের মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালও বিভিন্ন কারণে জামায়াতের নীতি-নির্ধারকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে তিন সিটিতেই বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থীদের সমর্থন দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী।

বিএনপির মেয়র প্রার্থীরা পরোক্ষভাবে নিজেদের পছন্দেরই- এ বিবেচনার পাশাপাশি তিন সিটিতেই জামায়াত সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের জয় নিশ্চিত করতে চায় জামায়াত। এ লক্ষ্যে বিএনপির সঙ্গে একটি সম্মানজনক সমঝোতায় পৌঁছতে চায় তারা। জামায়াত নেতাদের মতে, আওয়ামী লীগ তিন সিটিতেই মেয়র পদের পাশাপাশি ওয়ার্ডগুলোতেও এককভাবে কাউন্সিলর প্রার্থী দিয়েছে। এ কাজটি বিএনপি এখনও করতে পারেনি। যার সুফল পাবে আওয়ামী লীগসহ তাদের শরিকরা। অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিএনপি ও জামায়াত।

বিএনপি ইতোমধ্যে ঢাকার দু সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে দুটি নির্বাচন পরিচালনা সমন্বয় কমিটি গঠন করেছে। উত্তরে এ কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে। দক্ষিণের আহ্বায়ক দলের আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ। শুক্রবার খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে উত্তরের সমন্বয় কমিটি এবং একই দিন পুরানা পল্টনের বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দক্ষিণের সমন্বয় কমিটির দুটি পৃথক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

সূত্র জানায়, দু বৈঠকেই জামায়াত বাদে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক দলগুলোর নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় নির্বাচনের প্রস্তুতিসহ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু জামায়াতের কাউন্সিলর প্রার্থীর দাবি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। এ বৈঠকে জামায়াত নেতাদের অনুপস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির ঢাকা মহানগরের এক শীর্ষ নেতা বলেন, তারা এ বৈঠকের খবর জানতেন না। ওই নেতা আরও বলেন, বিএনপির আচরণ দেখে মনে হচ্ছে তারা একলা চলো নীতি অনুসরণ করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদেও নেতৃত্বাধীন বিএনপিপন্থি বিশিষ্ট নাগরিক ও ব্যক্তিদের সংগঠন আদর্শ ঢাকা আন্দোলন গত শুক্রবার ঢাকার দু সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সাধারণ এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ডে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট সমর্থিত ১১৪ প্রার্থীর একটি তালিকা প্রকাশ করে। তাতে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের ৯৩টি সাধারণ ওয়ার্ডে ৮৫ জন এবং ঢাকার দুই সিটির ৩১টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ২৯ জন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা সিটিতে জামায়াতের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক ও দলটির ঢাকা মহানগরের সেক্রেটারি নুরুল ইসলাম বুলবুল শুক্রবার বলেন, আদর্শ ঢাকা আন্দোলন ২০ দলীয় জোটের বরাত দিয়ে যে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে, সে সম্পর্কে আমরা অবহিত নই। এটি কোত্থেকে কিভাবে এলো, তা আমাদের জানা নেই। তিনি বলেন, জোটের কাউন্সিলর প্রার্থী ঠিক করা নিয়ে তাদের সাথে বিএনপি নেতাদের কোনো যোগাযোগ বা আলোচনা হয়নি।

আদর্শ ঢাকা আন্দোলন ঘোষিত এ তালিকায় জামায়াতের কারও নাম নেই। তাই তারাও বিএনপির পাশাপাশি ২৬টি ওয়ার্ডে দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থী দিয়েছে। একই অবস্থা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও। সেখানে ৫৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে সাধারণ ও সংরক্ষিত মিলিয়ে ১০টি ওয়ার্ড জামায়াতকে ছেড়ে দেয়ার কথা দিয়েছিলো স্থানীয় বিএনপি। কিন্তু এর ৮টিতেই তাদের বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে। পাল্টা হিসেবে জামায়াতও তিনটি ওয়ার্ডে বিএনপির পাশাপাশি তাদের দলের তিন প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৯ জন ও দক্ষিণে ১০ জন জামায়াত সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী রয়েছেন। এরা হলেন- ৩ নম্বর ওয়ার্ডে আশরাফুল আলম, ৪ নম্বর ওয়ার্ডে লস্কর মো. তাসলিম, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে এনায়েত হোসেন, ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে তারেক রেজা তুহিন, ২২ নম্বার ওয়ার্ডে মোস্তাফিজুর রহমান, ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে শরীফ মিজানুর রহমান, ২৯ নম্বর ওয়ার্ডে মো. ইকবাল, ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডে মনজুরুল আলম এবং ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে সালেহ সিদ্দিকী।

দক্ষিণের জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীদের মধ্যে আছেন- ১ নম্বর ওয়ার্ডে কবির আহমেদ, ৩ নম্বর ওয়ার্ডে শহীদুল ইসলাম, ৫ নম্বর ওয়ার্ডে উমর ফারুক মজুমদার, ৬ নম্বর ওয়ার্ডে গোলাম শাফি মহিউদ্দিন, ১১ নম্বর ওয়ার্ডে মোশাররফ হোসেন, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে আঞ্জুমান আরা রব, ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডে আতাহার আলী, ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডে আবদুল মান্নান, ৫২ নম্বর ওয়ার্ডে শফিকুল ইসলাম এবং ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডে আহমাদ হাসান।

এছাড়াও ঢাকা উত্তরে চারজন ও দক্ষিণে তিনজন নারীকে সংরক্ষিত ওয়ার্ডে জামায়াত সমর্থন দিয়েছে। তারা হলেন- উত্তরে উম্মে সালমা (৪, ১৫, ১৬ ওয়ার্ড), মাসুদা আক্তার (১২, ১৩, ১৪ ওয়ার্ড), আমেনা বেগম (২২, ২৩, ৩৬ ওয়ার্ড), কাওসার জাহান (২৯, ৩০, ৩২ ওয়ার্ড)। দক্ষিণে- শামিমা আকতার (২, ৩, ৪ ওয়ার্ড), দিলারা বেগম (১৩, ১৯, ২০ ওয়ার্ড) এবং হাসনাহেনা (৫২, ৫৩, ৫৪ ওয়ার্ড)। বিএনপির পাশাপাশি তারাও পুরোদমে নির্বাচনী প্রচারণা অব্যাহত রেখেছেন। ভোটের ময়দানে সরব আছেন।

সূত্র জানায়, ঢাকা উত্তর এবং দক্ষিণের মতোই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও কাউন্সিলর প্রার্থিতা নিয়ে মতবিরোধ চলছে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে। নগরীর ৫৫টি কাউন্সিলর পদের মধ্যে (৪১টি সাধারণ এবং ১৪টি সংরক্ষিত) জামায়াতকে ১০টি (৮টি সাধারণ এবং ২টি সংরক্ষিত) ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দেয় বিএনপি। কিন্তু এর মধ্যে জামায়াতের প্রার্থী রয়েছেন (১১টি সাধারণ এবং ২টি সংরক্ষিত) মোট ১৩টি ওয়ার্ডে। আবার জামায়াতকে ছেড়ে দেয়া ১০টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৫টিতেই বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী আছেন।

সংরক্ষিত দুটি মহিলা ওয়ার্ডসহ জামায়াতকে ছেড়ে দেয়া মোট ১০টি ওয়ার্ড হচ্ছে- ৮ নম্বর শুলকবহর, ১০ নম্বর উত্তর কাট্টলী, ১৩ নম্বর পাহাড়তলী, ১৬ নম্বর চকবাজার, ২৪ নম্বর উত্তর আগ্রাবাদ, ২৯ নম্বর পশ্চিম মাদারবাড়ি, ৩৫ নম্বর বক্সিরহার্ট এবং ৩৬ নম্বর গোসাইলডাঙ্গা ওয়ার্ড। দুটি সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ড হচ্ছে- পশ্চিম বাকলিয়া, পূর্ব বাকলিয়া ও দক্ষিণ বাকলিয়া (১৭, ১৮, ১৯) এবং দক্ষিণ হালিশহর, উত্তর পতেঙ্গা ও দক্ষিণ পতেঙ্গা (৩৯, ৪০, ৪১)। জামায়াতকে ছেড়ে দেয়া ১০টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৫টি ছাড়া সব কটিতে রয়েছেন বিএনপি প্রার্থী। এর বাইরেও জামায়াতের প্রার্থী রয়েছেন ৩ নম্বর পাঁচলাইশ, ১৭ নম্বর পশ্চিম বাকলিয়া এবং ৩৭ নম্বর মুনির নগর ওয়ার্ডে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম নগর বিএনপির সহ-সভাপতি আবু সুফিয়ান শুক্রবার বলেন, জামায়াতকে ১০টি ওয়ার্ড ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ওইসব ওয়ার্ডে বিএনপির নাম ভাঙিয়ে কেউ প্রার্থী হলেও তাদের সমর্থন দেয়া হয়নি। তিনি অভিযোগ করেন, জামায়াতকে ১০টি ওয়ার্ড ছেড়ে দেয়া হলেও তারা ১৩টি ওয়ার্ডে প্রার্থী দিয়েছে। এ নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ তারা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিরসনের চেষ্টা করবেন।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম নগর জামায়াতের প্রচার সম্পাদক মোহাম্মদ উল্লাহ বলেন, চসিক নির্বাচনে জামায়াত ১৩টিতে কাউন্সিলর প্রার্থী দিয়েছে। অধিকাংশ ওয়ার্ডে বিএনপির প্রার্থীও রয়েছেন। জামায়াতকে ছেড়ে দেয়া ওয়ার্ডগুলো থেকে বিএনপি প্রার্থীরা যাতে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান সেজন্য বিএনপি নেতাদের সাথে কথা হচ্ছে। আশা করি নির্বাচনের আগ মুহূর্তে হলেও জামায়াতকে ছেড়ে দেয়া ওয়ার্ডগুলোতে ২০ দলের পক্ষে অন্য কোনো প্রার্থী থাকবে না।

জানা গেছে, গত সিটি নির্বাচনে ৮ নম্বর শুলকবহর ওয়ার্ড থেকে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী শামসুজ্জামান হেলালী জয় লাভ করেন। এবারও এ ওয়ার্ডটি জামায়াতকে ছেড়ে দিয়েছে বিএনপি। এরপরও জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী শামসুজ্জামান হেলালীর সাথে এবার বিএনপি থেকে এ ওয়ার্ডে প্রার্থী হয়েছেন গোলাম মনসুর। ১০ নম্বর উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডে জামায়াত সমর্থিত ডা. মো. শাহাদাত হোসেনের সাথে বিএনপি সমর্থিত দু প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন। এরা হচ্ছেন মোহাম্মদ শওকত আলী চৌধুরী ও মো. শামশুল আলম। ২৯ নম্বর পশ্চিম মাদারবাড়ি ওয়ার্ডে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী ফজলে এলাহী শাহীনের সঙ্গে বিএনপি থেকে প্রার্থী হয়েছেন সুমন মাহমুদ চৌধুরী। ৩৫ নম্বর বক্সিরহাট ওয়ার্ডে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী শেখ আহমদুর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মো. জসীম উদ্দিন। এছাড়া ৩ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপি থেকে প্রার্থী হয়েছেন আইয়ুব খান ও মোহাম্মদ ইসমাইল। এ ওয়ার্ডে জামায়াত থেকে প্রার্থী হয়েছেন ইসমাইল হোসেন সিরাজী। ৩৭ নম্বর মুনিরনগর ওয়ার্ডে ২০ দলীয় জোট থেকে প্রার্থী হয়েছেন বিএনপি সমর্থিত বর্তমান কাউন্সিলর হাসান মুরাদ। এ ওয়ার্ডে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী শফিউল আলম মাঠে আছেন। ১৭ নম্বর পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ডে বিএনপি থেকে প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান কাউন্সিলর একেএম জাফরুল ইসলাম। এখানে জামায়াত থেকে প্রার্থী হয়েছেন আহমেদুল হক।