রাজনৈতিক সহিংসতায় ক্ষতি ১৭ হাজার কোটি টাকা

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ

 

স্টাফ রিপোর্টার: দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করা। যা টেকসই প্রবৃদ্ধির পূর্বশর্ত। কিন্তু এ অস্থিরতাই একমাত্র চ্যালেঞ্জ নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য আরও ৬টি ঝুঁকি রয়েছে বলে জানিয়েছে দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক। বহুজাতিক এ সংস্থাটি বলছে, অস্থিরতা ও সহিংসতা না থাকলে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারত। কিন্তু সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশে ১৭ হাজার ১৫০ কোটি টাকা উৎপাদন ক্ষতি হয়েছে। এতে চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ কমে দাঁড়াবে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে।

গতকাল রোববার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে এ প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। এতে স্বাগত বক্তব্য দেন সংস্থাটির কান্ট্রি ডিরেক্টর জোহানেস জাট। জাহিদ হোসেন বলেন, যদি রাজনৈতিক পরিস্থিত স্থিতিশীল থাকত তাহলে বাংলাদেশে চলতি অর্থবছরে (২০১৪-১৫) জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারতো ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। সাম্প্রতিক হরতাল-অবরোধের ৬০ দিন বিবেচনায় যে ক্ষতি হয়েছে তা মোট জিডিপির ১ শতাংশ।

প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের তুলনায় দেশে উৎপাদনের পরিমাণ দৈনিক ভিত্তিতে বেড়েছে। এ জন্য ক্ষতির পরিমাণও বেড়েছে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে টানা এ অস্থিরতায় কৃষি খাতে ক্ষতি হয়েছে মোট উৎপাদনের ৭ শতাংশ, শিল্প খাতে ২৫ শতাংশ আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সেবা খাতে। এ খাতে ক্ষতির পরিমাণ ৬৮ শতাংশ। আগের বছর অস্থিরতা ছিলো ৪৫ দিন। এবার ছিলো ৬০ দিন। জাহিদ হোসেন এ বিষয়ে বলেন, অস্থিরতায় তিন কারণে আগেরবারের (২০১৩) চেয়ে এ বছর ক্ষতির পরিমাণ বেশি। অস্থিরতার সময়কালটা দেখতে হবে। এ বছর এমন সময়ে এ অস্থিরতা শুরু হয়েছে, যখন কৃষকরা উৎপাদিত ফসল ঘরে তুলছে, শুষ্ক মরসুমে নির্মাণকাজ চলছে, আর পর্যটনের উপযুক্ত সময় চলছিলো। নিয়মানুসারে দৈনিক হিসাবে দেশের উৎপাদনের পরিমাণ গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। ফলে ক্ষতির পরিমাণও বেড়েছে।

প্রতিবেদন অনুসারে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকেই অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করে বিশ্বব্যাংক। কেননা টেকসই উন্নয়নে এটি অন্যতম পূর্বশর্ত। অন্যান্য চ্যালেঞ্জগুলোও ছোট নয়। এছাড়া বৈশ্বিক মন্দা ও ডলারের বিপরীতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মুদ্রা ইউরোর দরপতন, গার্মেন্ট খাতের কারখানা সংস্কার তথা শ্রমিকের নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং অবকাঠামো উন্নয়ন দুর্বলতা রয়ে গেছে। এ অবস্থা মোকাবিলায় রাজস্ব আহরণ নিশ্চিতকরণ, বিনিময় হার নমনীয় রাখা ও আর্থিক খাতে জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বাড়াতে ইকোনমিক জোনগুলোর বাস্তবায়নের গতি বাড়ানো, ব্যবসায়িক পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, বেসরকারি বিনিয়োগে জমির সহজলভ্যতা নিশ্চিতকরণ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়ানো এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণের হার বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুসারে দেশে প্রতিবছর ১৩ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। কিন্তু সে অনুসারে নারীর কর্মসংস্থান বা অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে না। সংস্থাটি বলছে, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে এখনও দুর্বলতা রয়ে গেছে। কাক্সিক্ষত জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে চাইলে বিনিয়োগের পরিমাণ আরও ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৩৩ থেকে ৩৪ শতাংশে নিয়ে যেতে হবে। দেশে বর্তমানে ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ হারে বিনিয়োগ হচ্ছে।

সংস্থাটি বলছে, দেশের ব্যাংকিং খাতে সুদের হার কাঙ্ক্ষিত হারে কমছে না। ব্যাংকিং খাতে পরিমাণ তারল্যপ্রবাহ রয়েছে তার তুলনায় সুদের হার অনেক বেশি। অধিক হারে ঋণ দেয়ার ফলেও ব্যাংকগুলো সে অনুসারে রিটার্ন পাচ্ছে না। এর মূল কারণ হচ্ছে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি। বিশ্বব্যাংকের মতে, বড় বড় ব্যবসায়ীদের জন্য যে ঋণ সুবিধা দেয়ার নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সংস্থাটির মতে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কিছুটা স্বস্তি থাকলেও রফতানি সমস্যা রয়ে গেছে। বিশেষ করে গার্মেন্ট খাতে ইমেজ সংকট এখনও প্রকট। ইউরো জোনের দরপতনের ফলে একদিকে ওই দেশগুলোর আমদানি কমিয়ে দিয়েছে অধিক মূল্য দিতে হচ্ছে বিধায়। অন্যদিকে অনেক ব্যবসায়ীর রফতানির মুনাফার পরিমাণ কমে গেছে। এ জন্য মুদ্রা বিনিময় হারকে নমনীয় রাখার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।

বাজেটে প্রস্তাবিত মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যেই থাকবে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। এক প্রশ্নের জবাবে জাহিদ বলেন, ৩ লাখ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট অবশ্যই উচ্চবিলাসী। এটা গতানুগতিক একটা নিয়ম হয়ে গেছে। পরে সংশোধন ছাড়া এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। মাঝপথে এসে সংশোধন করা হয়। আগামী বাজেটও সংশোধন করা ছাড়া বাস্তবায়ন হবে না বলে মনে করেন তিনি।

Leave a comment