আলমডাঙ্গার বেদ আর দামুড়হুদার পালবাড়িগুলোতেও লেগেছে বর্ষবরণের রঙ
খাইরুজ্জামান সেতু/বখকতিয়ার হোসেন বকুল: বছর ঘুরে হাজির পয়লা বোশেখ। দরজার কড়া নাড়ছে ক’দিন ধরেই। শহর-বন্দর-গ্রামে-গঞ্জে বোশেখি মেলার প্রস্তুতি ব্যস্ত করে তুলেছে যেমন কুমারদের, তেমনি ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে বেদ সম্প্রদায়।
পয়লা বোশেখ সামনে রেখে খস, খস, পট, পট শব্দে মুখরিত চুয়াডাঙ্গার বেদ সম্প্রদায়ের পল্লি গুলো। আলমডাঙ্গার স্টেশনের অদূরেই রয়েছে বেশ কয়েকটি বেদ পরিবার। ব্যস্ত দিন পার করছে তারা। কুলা, ঝুড়ি, ফুলদানি, কলমদানি, ফাতি, সরপস, ফলদানিসহ বিভন্ন খেলনা সমগ্রী তৈরি করছে। আর তাদের তৈরি পণ্য নিয়েই পয়লা বোশেখসহ বিভিন্ন মেলায় দোকানিরা পসরা সাজান। চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার শ্রীমতিন আশারাণী বেদ জানান, আমাদের তৈরি এ পণ্য দেশসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হয়। বিভিন স্থান থেকে পাইকারি ক্রেতারা এসে আমাদের এসব পণ্য কিনে নিয়ে যান। শ্রীমতি ডালিম রাণী বেদে জানান, বাঁশের তৈরি এ বিভিন্ন পণ্য তৈরি করতে নারী-পুরুষ সবাই মিলে নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছি। কারণ একটাই অন্য সময়ের তুলনায় এখন দামও বেশি পাওয়া যায়। বিক্রিও হয় বেশি। আর আমাদের অন্য সময় একেবারেই বসে সময় কাটাতে হয়। যদি কেউ অর্ডার দেন ভালো। না হলে কোনো কাজ থাকে না। কুমারী চন্দ্রা রাণী বেদ জানান, বছরের অন্য সময়য়ের তুলনায় পয়লা বোশেখ এলেই তাদের ব্যস্ততা অনেক বেড়ে যায়। এমন ব্যস্ততা কাউরের সাথে কথা পর্যন্ত বলার সময় থাকে না। বেদে সম্প্রদায়ের নাম প্রকাশ না করার শর্তে আক্ষেপ করে বলেন, আমরা দরিদ্র। আমাদের সিজেন না থাকলে কোনো আয় নেই। তাও আমাদেও সিজেন পয়লা বোশেখ সামনে। কিন্তু অনেকই নাম ঠিকানা লিখে নিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারি কউরের কাছ থেকে কোনো প্রকার কোনো সহায্য সহযোগিতা পাইনি। কিন্তু শোনা যায় অনেক জায়গায় সাহায্য সহযোগিতা করে।
দামুড়হুদার বিষ্ণুপুরে বোশেখি মেলাকে সামনে রেখে ব্যস্ত সময় পার করছেন পালবাড়ির মৃৎশিল্পীরা। রাত-দিন অবিরাম চলছে মাটি দিয়ে হাতি, ঘোড়া, পাখি, মাছ, ব্যাংক, জাঁতা, বৌ পুতুল, ঝাঁঝরি, ফুলের টব, হাড়ি-পাতিলসহ হরেক রকম খেলনা সামগ্রী তৈরির কাজ। আর ওই সমস্ত কাজে পুরুষের পাশাপাশি সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করে চলেছেন পালবাড়ির নারীরা। রঙ আর তুলির আঁচড়ে নতুন রূপে রাঙিয়ে তুলছেন মাটির তৈরি বিভিন্ন খেলনা সামগ্রী। বাংলা নববর্ষের আগমনী বার্তায় বিষ্ণুপুরের পালবাড়িগুলো সেজেছে বর্ণিল সাজে। মৃৎ শিল্পীদের মনে লেগেছে রঙিন দোলা। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে প্লাস্টিক সামগ্রী বাজার দখল করলেও বংশ পরম্পরায় প্রায় দেড়শ বছরের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রেখেছে বিষ্ণুপুরের এ পাল সম্প্রদায়। বিষ্ণুপুরের পালবাড়ির মঙ্গলচন্দ্র দেবনাথের ছেলে দুলাল চন্দ্র দেবনাথ জানান, বোশেখি মেলা উপলক্ষে প্রায় দেড়শ বছর আগে স্বর্গীয় গগন চন্দ্র দেবনাথ প্রথম এ সমস্ত মাটির খেলনা সামগ্রী তৈরি শুরু করেন। এরপর তার ছেলে রামচন্দ্র দেবনাথ এবং তার দু ছেলে মঙ্গলচন্দ্র দেবনাথ ও ষষ্ঠীচন্দ্র দেবনাথ বংশ পরম্পরায় এ শিল্পকে টিকিয়ে রেখেছেন। আমরা তাদেরই বংশধর।
তিনি আরো জানান, বোশেখি মেলা শুরুর প্রায় ৬ মাস আগে থেকে চলে প্রস্তুতি। রঙের মূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি বেশি দাম দিয়ে মাটি কিনে ওই সমস্ত খেলনা সামগ্রী তৈরি করে বর্তমানে খুব বেশি লাভ হয় না। তাই অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিচ্ছে। আগে পুরো বছর জুড়েই কাজ থাকতো। ছাদের টালি, গুড়ের ভাড়, দইয়ের ছোবা, পানির কলস, কুয়োর পাট, রুটি তৈরির তাওয়া, পানের বাটা, হাড়ির সরা, মালসা, নান্দাসহ প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করা হতো। ৫ বছর আগেও ওঠানে জাগা হতো না। আগের মতো চাহিদা না থাকায় ওগুলো আর তেমন তৈরি করা হয় না। বর্তমানে প্রতিবেশী অনাথ দেবনাথ, সান্নাসী দেবনাথ, শান্তি পাল, ভজন পাল, বিমল পাল এ ৭-৮ ঘর এ পেশায় নিয়জিত আছে। আগে পার্শ্ববর্তী মেহেরপুর জেলাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকার ক্রেতারা আসতো এ সমস্ত খেলনা কিনতে। এখনও আসে তবে আগের তুলনায় অনেকটাই কম।
মঙ্গলচন্দ্র দেবনাথের স্ত্রী শ্রীমতি সুমীত্রা রানী দেবনাথ বলেন, আমি প্রায় ৪০ বছর ধরে মাটির তৈরি ওই সমস্ত খেলানায় রঙ করে থাকি। মাটির তৈরি হরেক রকম খেলনায় রঙ করতে আমার ভালোই লাগে। এ সমস্ত খেলনার মধ্যে বড় সাইজের একটি ব্যাংক ২০ টাকা, জাঁতা ১০ টাকা, একটি বড় বৌ পুতুল ১৫ থেকে ২০ টাকা। ৫ টাকা দামেরও আছে। এছাড়া ঘোড়া ১০ টাকা, কড়াই ১০, ঘুঘুপাখি ১০, মোরগ ১০, মাছ আকৃতির ব্যাংক ১৫ থেকে ২০ টাকায় বিক্রি করা হয়। তিনি আরো বলেন, আমরা যারা বর্তমানে এ পেশায় নিয়োজিত আছি তাদের কারোরই পুঁজি নেই। বোশেখি মেলাকে সামনে রেখে সরকার যদি বিনাসুদে ঋণ দিতো তাহলে আমাদের পক্ষে খুবই সুবিধা হতো। মৃৎশিল্পীদের পাশাপাশি পিছিয়ে নেই ওই এলাকার কামার সম্প্রদায়। বোশেখি মেলাকে সামনে রেখে পাল্লা দিয়ে তৈরি করে চলেছে লোহার তৈরি ছোট ছুরি, দা বটিসহ বিভিন্ন সামগ্রী।
বিষ্ণুপুরের মৃত গৌর কর্মকারের ছেলে সুশান্ত কর্মকার জানান, আমরা ৩০ ঘর এ পেশায় নিয়োজিত আছি। তবে আগের তুলনায় এ সমস্ত জিনিসের চাহিদা খুবই কম। বাংলা নববর্ষ-১৪২২ আর মাত্র কদিন বাকি। পুরো বছর জুড়ে প্রতিটি বাঙালি এ দিনটির জন্য অপেক্ষায় থাকেন এবং নববর্ষের প্রথম প্রভাতে মেতে ওঠে নতুন উন্মাদনায়। বাংলা নববর্ষের প্রথম প্রহরে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে বের করা হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। নানা রঙে, ঢঙে বাঙালির আদি সংস্কৃতিকে তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা ফুটে ওঠে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে। পান্তা-ইলিশ নববর্ষে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। অন্য বছরের ন্যায় এবারও এ দিনটিতে লাঠিখেলার পাশাপাশি থাকবে বর্ণাঢ্য নানা আয়োজন এমনটিই জানিয়েছেন দামুড়হুদা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. ফরিদুর রহমান।