‘সব অশুভ-অকল্যাণ-অপশক্তি-অপসংস্কৃতি চলে যাক বহুদূর—
বাংলা নববষের্র শুভ-কল্যাণ-মঙ্গলবারতায় জীবন হয়ে উঠকু সুমধর’
মানুষের জীবনাচরণের সাথে অঙ্গীভূত সকল কিছুই সংস্কৃতির উপাদান। বাঙালি এবং বাংলাদেশের সংস্কৃতি হাজারো ভাঙা-গড়ার ইতিহাস এবং জীবনাচরণের সাথে সম্পৃক্ত। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বিবর্তিত হতে হতে বাংলাদেশের সংস্কৃতি আজকের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। বাঙালি বা বাংলাদেশি সংস্কৃতি কোনো অখণ্ড অথবা অভিন্ন সংস্কৃতি নয়। এ সমাজ যেমন বহু ভাগে বিভক্ত, এ সংস্কৃতিও তেমনি বহু রঙে রাঙানো। তবে, বাঙালি সংস্কৃতিতে যে সব অভিন্ন উপাদান আছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ‘বাংলা নববর্ষ’।
বাংলাদেশ এবং বাঙালির জীবনে নানারকম উৎসব-অনুষ্ঠান আছে। বারো মাসে তেরো পার্বন, দুটি ঈদ, বড় দিন, মাঘী পূর্ণিমা, বৌদ্ধ পূর্ণিমা, আদিবাসীদের বিভিন্ন উৎসব আমাদের দেশের যেন উৎসবেরই রঙ ছড়িয়ে দেয়। আমরা ধর্মীয় বিবেচনায় হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান বিভিন্ন বর্ণে বিভক্ত কিন্তু আমরা সবাই জাতিতে বাঙালি- আর আমাদের বাঙালির প্রাণের উৎসব ‘বাংলা নববর্ষ’। কল্যাণ-শুভবারতা ও নতুন জীবনের প্রতীক হলো নববর্ষ। অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপিত হয় বাংলা নববর্ষ। বাংলা নববর্ষ কোনো ধর্মীয় উৎসব নয়- এটি আজ আমাদের দেশে অসাম্প্রদায়িক জাতীয় উৎসব; আবার আমাদের জাতীয় উৎসবে দেশি-বিদেশি অসংখ্য পর্যটক এসে এ উৎসবকে আন্তর্জাতিক উৎসবেরও রঙ ছড়িয়েছে। পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানের গণ্ডি অতিক্রম করে বাংলার সাংস্কৃতিক জীবনে বাংলা নববর্ষের উৎসব আজ ‘সার্বজনীন উৎসব’ হিসেবে স্বীকৃত। বাঙালির জীবনে নববর্ষের তাৎপর্য ও গুরুত্ব অত্যধিক। তা ধর্ম বা সম্প্রদায়-নির্ভর কোনো অনুষ্ঠান নয়; তা সব ধর্ম-শ্রেণি-পেশার মানুষের- বাঙালির জাতীয় উৎসব।
নববর্ষ অনুষ্ঠানের প্রাচীন ধারার দিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে যে জিনিসটি চোখে পড়ে তা হলো এক সময় নববর্ষ পালিত হতো ‘আর্তব উৎসব’ বা ‘ঋতুধর্মী উৎসব’ হিসেবে। তখন এর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো কৃষির বা ফসলের সাথে। আজকাল বৈশাখ মাসে নববর্ষের সূচনা ধরা হলেও প্রাচীনকালে এদেশে নববর্ষ শুরু হতো অগ্রহায়ণ মাসে। ‘অগ্রহায়ণ’ নামটির অর্থের মধ্যেই বছরের প্রথম মাসের ইঙ্গিত রয়েছে। ‘হায়ণ’ এর একটি অর্থ হলো বছর। এ-বিবেচনায় ‘অগ্রহায়ণ’ মাস হলো বছরের প্রথম মাস। ‘হায়ণ’ শব্দটি শস্য বা ধান অর্থেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আর ‘অগ্র’ শব্দটি ‘সেরা’ বা ‘প্রথম’ অর্থেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ অগ্রহায়ণ মাসের নাম এসেছে ‘অগ্রহায়ণী’ নক্ষত্রের নাম থেকে। প্রচলিত ধারণা ছিলো যে, ‘অগ্রহায়ণী’ নক্ষত্রের উদয়ে ধান পাকে।
তবে এটা স্পষ্ট যে বাঙালির জীবনে নববর্ষ এবং তাকে উপলক্ষ করে উৎসবের সূচনা হয়েছে ফসল উৎপাদনের সূত্রে। আর প্রথমে সে উৎসব পালিত হতো অগ্রহায়ণে, বর্তমানের মতো বৈশাখে নয়। এ প্রসঙ্গে এটাও উল্লেখ্য যে, ‘যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি তাঁর ‘পূজাপার্বন’ গ্রন্থে জানিয়েছেন, প্রাচীনকালে এক সময় ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে নববর্ষের উৎসব অনুষ্ঠান হতো।’ বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ ‘বাংলা পিডিয়া’র তথ্যানুসারে কৃষিকাজের সুবিধার্থে মুঘল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০-১১ মার্চ বাংলা সন প্রবর্তন করেন। হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌরসনকে ভিত্তি করে বাংলা সন প্রবর্তন করেন। নতুন সনটি প্রথমে ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত ছিলো, পরে তা ‘বঙ্গাব্দ’ নামকরণ করা হয়। তবে সম্রাট আকবরের সময় থেকে বাংলা নববর্ষ ভিন্নমাত্রায় পালিত হতে থাকে। অনুমান করা হয় বাঙালি সংস্কৃতির পুরোধা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনে বৈশাখ মাসে নববর্ষের উৎসবের আয়োজন করে এ উৎসবকে অধিকতর সাংস্কৃতিক ও সামাজিক তাৎপর্যমণ্ডিত করে গেছেন এবং তা বাঙালি মানসে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে।
নববর্ষের উৎসবের সাথে তিনটি প্রধান অনুষ্ঠান সম্পর্কিত : পুণ্যাহ, হালখাতা ও বৈশাখি মেলা। এগুলো খুব প্রাচীনকালের নয়। তবে আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এদের ভূমিকা থেকেও অনুমিত হয় যে, এগুলো ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পর্যায়ে পড়ে না। পূণ্যাহ অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য ছিলো বছরের শুরুতে শুভদিনে খাজনা আদায় আরম্ভ করা। এটি ছিলো জমিদার ও সর্বস্তরের প্রজার সর্বজনীন অনুষ্ঠান। ‘হালখাতা’ অনুষ্ঠানের দিনে ক্রেতা-বিক্রেতার পুরোনো অর্থনৈতিক লেনদেন মিটিয়ে আবার নবোদ্যমে আরম্ভ করে আগামী দিনের পথে। ক্রমান্বয়ে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে পহেলা বৈশাখ আনন্দময় ও উৎসবমুখি হয়ে ওঠে এবং বাংলা নববর্ষ শুভদিন হিসেবে পালিত হতে থাকে। নববর্ষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক বৈশাখি মেলার আয়োজন। নাগরদোলার ঘূর্ণিপাক, তালপাতার বাঁশি, লোকশিল্পের সামগ্রী বেচা-কেনা, খেলনা ও বিভিন্ন মিষ্টান্নের বিপুল সমাহার, নানা রকম গৃহস্থালির বেসাতি, বাউল ও লোকসঙ্গীতের আসর, গ্রাম্য নৃত্য, পুতুল নাচ, দলবেঁধে ঘুরে বেড়ানো এগুলো বৈশাখি মেলার প্রধান আকর্ষণ।
বাংলাদেশের ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নববর্ষের অনুষ্ঠান বা উৎসব বিশেষ সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্যে অভিসিক্ত। আইয়ুব খানের শাসনামলে অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা আন্দোলনের সাথে বাংলা নববর্ষ পালনেও তৎকালীন সরকার বাঁধার সৃষ্টি করে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ‘নববর্ষ হিন্দুয়ানি অনুষ্ঠান’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তাকে বাংলা এবং বাঙালির জীবন থেকে মুছে দিতে চেয়েছিলো কিন্তু বাঙালি জাতি সেই চক্রান্ত নস্যাৎ করে দিয়ে তাকে জাতীয় উৎসবে পরিণত করে। অবদমিত বাঙালি শাসকের নির্দেশ অমান্য করে বাংলা নববর্ষ পালন করে; রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের উদ্যোগে গড়ে ওঠে ছায়ানট (১৯৬১) সংগঠন। আইয়ুব সরকারের সংস্কৃতি চর্চার বিরোধিতার প্রতিবাদস্বরূপই বৈশাখের প্রথম দিনে ছায়ানট রমনার বটমূলে নববর্ষ পালনের আয়োজন করে। পরে ক্রমশই এ অনুষ্ঠান বিপুল জনসমর্থন লাভ করে এবং স্বাধীকার আন্দোলনের চেতনায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নীতির বিরুদ্ধে ও বাঙালি আদর্শের লালনে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় বাংলা নববর্ষ পালিত হতে থাকে।
বাংলা নববর্ষ আজ বাঙালির মহামিলন মেলায় রূপান্তরিত। আমরা এ জায়গাতে দারুণভাবে ঐক্যবদ্ধ এবং রোমাঞ্চিতও বটে। এখানে আরেকটু কথা যোগ করতে চাই, ভিন্ন ভিন্ন দলের রাজনীতিবিদদের মধ্যে অধিকাংশ বিষয়ে অমিল লক্ষ্য করা গেলেও আমরা নববর্ষ পালনে কিন্তু কোনো বিভেদ লক্ষ্য করি না- বরং আমরা অন্তত এ সময়টাতে দেখতে পাই এক নেত্রী আরেক নেত্রীকে, এক নেতা আরেক নেতার সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা দিচ্ছেন এবং নিচ্ছেন। নববর্ষ পালন শুধু বাঙালিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই- বাংলা নবর্ষ ও চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে তিন পাবর্ত্য জেলায় (রাঙামাটি, বান্দরবন ও খাগড়াছড়ি) আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী ‘বৈসাবি’ উৎসব আনন্দমুখর পরিবেশে পালিত হয়। ‘বৈসাবী’ হলো পাহাড়িদের সবচেয়ে বড় উৎসব- এ উৎসবে চাকমারা ‘বিজু’ মারমারা ‘সাংগ্রাই’ এবং ত্রিপুরারা ‘বৈসুক’ উৎসব পালন করে। তবে আজকাল নববর্ষ গ্রামে-শহরে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের আনন্দ মিলন-চেতনার নতুন ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছে। প্রতিটি জেলা শহরেই আয়োজন করা হয় বৈশাখি মেলার। ঢাকায় চারুকলা অনুষদ থেকে সকাল বেলা ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ বের হয় এবং সূর্যোদয়ের সাথে সাথে রমনাপার্কে ‘ছায়ানট’ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে মানুষকে বিমোহিত করে। এছাড়া বাংলা একাডেমী মাসব্যাপি বৈশাখি মেলার আয়োজন করে। তাই এসব বিবেচনায় বাঙালি এবং বাংলাদেশিদের জীবনে নববর্ষ যে নতুন প্রাণের স্পন্দন সৃষ্টি করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বাংলা নববর্ষ উদযাপনের মধ্যদিয়ে জাতি হিসেবে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সচেতনতা বৃদ্ধি করে; তা সাংস্কৃতিক জাতি কিংবা রাষ্ট্রজাতি হিসেবে আমাদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে শক্তি যোগায়। যারা ধর্ম, বর্ণ, গোত্র চেতনা ও আঞ্চলিকতার গোঁড়ামি দিয়ে আমাদের জাতীয় বিকাশে ফাটল ধরাতে চায় তাদের অপচেষ্টা প্রতিহত করে এগিয়ে যেতে নববর্ষ হয়ে ওঠে আমাদের চেতনার মশাল। এ মিলনোৎসবের ভেতর দিয়ে আমাদের জীবনে প্রীতিময়তার বিস্তার ঘটে। শুভ ইচ্ছা, শুভ সংকল্প, সকল বাঁধার পাহাড় ডিঙিয়ে এগিয়ে চলার প্রেরণায় আমাদেরকে উজ্জীবিত করে।
ডক্টর এমএ রশীদ
সহকারী অধ্যাপক
সরকারি আদর্শ মহিলা কলেজ, চুয়াডাঙ্গা।