ঢাকা থেকে বরিশাল যাওয়ার পথে ফরিদপুরে নৈশকোচ সোনারতরী দুর্ঘটনার কবলে
স্টাফ রিপোর্টার: ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলায় বুধবার গভীর রাতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি যাত্রীবাহী বাস রাস্তার পাশের গাছের সাথে ধাক্কা খায়। এতে ২৫ জন বাসযাত্রী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরো ২০ জন। সোনারতরী পরিবহনের বাসটি রাতে ঢাকা থেকে যাত্রী নিয়ে বরিশাল যাচ্ছিলো। নিহতদের মধ্যে ২০ জন পুরুষ ও পাঁচজন নারী। আহতদের ২০ জনকে ভাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। দুর্ঘটনার কারণ খুঁজতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ঘটনায় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোক প্রকাশ করেছেন।
আহত যাত্রীদের বরাত দিয়ে ফরিদপুর ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক শামসুজ্জোহা বলেন, দ্রুত গতিতে থাকা বাসটি ভাঙ্গা মোড় পেরিয়ে টেকেরহাটের দিকে দেড় থেকে দু কিলোমিটার যাওয়ার পর চালক নিয়ন্ত্রণ হারান। এরপর বাসটি রাস্তার পাশের একটি গাছের সাথে সজোরে ধাক্কা খায়। পরে আরো কয়েকটি গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে কাত হয়ে দু ভাগ হয়ে যায়। বাসটি প্রচণ্ড গতিতে থাকার কারণে হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে বলে ফায়ার কর্মীরা জানিয়েছেন।
নিহতরা হলেন বরিশাল সদরের আবজাল হোসেন (৩৫), বাহাদুর মিয়া (৩০), শাহারিয়ার কবির (২৮) ও সোহাগ (৩০)। পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া থানার হাসনা বেগম (৪৫), জুয়েল (৩৫), মাহমুদুল হাসান (২০), নাজমা বেগম (৩০), আকলিমা আক্তার (১০), রেজাউল হক (২৫), কবির ফকির (৩৮), হেলালউদ্দিন (৩০), আমেনা বেগম (২৫), সূর্য বেগম (৬০) ও সুমন (২৮), খেপুপাড়া থানার আসমা বেগম (২০), বড়গুনা জেলার আমতলী থানার রাবেয়া বেগম (৭০), টুটুল হাওলাদার (৪৫), রতন সানাল (৩০) ও বারেক (৩০), দিনাজপুর সদরের মামুন (৩৫) ও আবু বক্কার (৩০)। যশোর কোতয়ালি থানার মনিরুল ইসলাম (৩৫), গোপালগঞ্জ জেলার শফিকুল ইসলাম (২৫) ও ফরিদপুর জেলার মোবারক হোসেন (৩২)। ফরিদপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এদের সকলের লাশ গতকাল বিকেলের মধ্যে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
ভাঙ্গা হাইওয়ে থানার ওসি হোসেইন সরকার জানান, ঢাকা থেকে বরিশালের উদ্দেশে ছেড়ে আসা সোনারতরী পরিবহন (ঢাকা-মেট্রো-ব-১৪-৭০৭৪) দুর্ঘটনাস্থলে আসলে চালক সামনে থাকা সাকুরা পরিবহনকে ওভারটেক করার সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সাথে ধাক্কা দেয়। এ সময় বাসটির মাঝখান হতে দু ভাগে ভাগ হয়ে যায়। গভীর রাত ও ঘন কুয়াশার কারণে বেঁচে থাকা যাত্রীদের চিত্কারে স্থানীয়রা প্রথমে এগিয়ে এসে পুলিশে খবর দেয়। উদ্ধারকারীরা বাসটির ভেতর থেকে ১৯টি মৃতদেহ উদ্ধার করে এবং গুরুত্বর আহত ২০ জনকে হাসপাতালে পাঠায়। আহতদের মধ্যে ভাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩ জন ও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩ জন মারা যায়। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। ফরিদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন, হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি মল্লিক ফকরুল ইসলাম, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার ফারুক হোসেন, ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক সরদার সরাফত আলী, পুলিশ সুপার জামিল হাসান, ৱ্যাব ফরিদপুর ক্যাম্পের অধিনায়ক আমিনুর রহমান দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা প্রদান ও আহতদের চিকিত্সার দায়িত্ব নেয়া হয়।
দুর্ঘটনার কারণ খুঁজতে দুটি তদন্ত কমিটি: দুর্ঘটনায় ২৫ জনের মৃত্যুর বিষয়টি খতিয়ে দেখতে দুটি তদন্ত কমিটি করেছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসন। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় গঠিত ৫ সদস্যের কমিটির নেতৃত্ব দেবেন ফরিদপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। জেলা পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, বিআরটিএ ও হাইওয়ে পুলিশের প্রতিনিধিরা কমিটিতে থাকবেন। এ কমিটি সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে। এছাড়া ফরিদপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘটনা তদন্তে আরেকটি কমিটি করা হয়েছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আব্দুর রশিদকে প্রধান করে গঠিত তিন সদস্যের একটি কমিটিকে দু দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে বলে জেলা প্রশাসক সরদার সরাফত আলী জানান। দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনায় শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আহতদের সুচিকিত্সা নিশ্চিত করতে তিনি ফরিদপুরের জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, চিকিত্সকসহ সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন।
ডাকাতিকে কেন্দ্র করে এ দুর্ঘটনা দাবি চালকের: ডাকাতির ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করেছেন সোনারতরী পরিবহনের চালক ও হেলপার। দুর্ঘটনার পর ওই যাত্রীবাহী বাসচালক জাকির (৩৬) ও হেলপার মন্টুকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
দুর্ঘটনার আগে বাসে ডাকাত দলের সদস্যরা অবস্থান করেছিলো এমনটা দাবি করে হাসপাতালে চিকিত্সাধীন জাকির জানান, ঘটনার মিনিট পাঁচেক আগে ডাকাত দলের তিন সদস্য বাসের নিয়ন্ত্রণ নিতে চেয়েছিলো। এ নিয়ে তাদের সাথে বাগবিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে ডাকাতদের অস্ত্রের আঘাতে তিনি আহত হয়ে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে এ দুর্ঘটনা ঘটে। হেলপার মন্টুও চালকের সাথে সুর মিলিয়ে একই কথা বলেছেন।
চালক ও হেলপারের বিরুদ্ধে মামলা: এ দুর্ঘটনায় বাসচালক মো. জাকির হোসেন এবং তার সহকারী (হেলপার) মো. মন্টু খানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ভাঙ্গা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নাজমুল ইসলাম জানান, হাইওয়ে থানায় গতকাল দুপুরে মামলা হয়েছে। ভাঙ্গা হাইওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ হোসেন মামলাটি দায়ের করেন।
পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ৮ পরিবারে শোকের মাতম: ভাঙ্গায় দুর্ঘটনায় নিহত যাত্রীদের মধ্যে ৮ জন পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার। এসব পরিবারে মৃত্যুর খবর আসার সাথে সাথে কান্নার রোল পড়ে যায়। তাদের আর্তনাদে ওই এলাকার বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। গতকাল বিকালে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নিহত পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ১৫ হাজার টাকা করে নগদ অর্থ সাহায্য প্রদান করা হয়।