বৃহত্তর কুষ্টিয়ার কিংবদন্তীতুল্য মুক্তিযোদ্ধা আলমডাঙ্গার কাজী কামালের ইন্তেকাল

আলমডাঙ্গা ব্যুরো: বৃহত্তর কুষ্টিয়ার কিংবদন্তীতুল্য মুক্তিযোদ্ধা, আলমডাঙ্গা থানা মুজিব বাহিনীর কমান্ডার কাজী কামাল ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি……..রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৭২ বছর। দীর্ঘদিন হার্ট ও কিডনিজনিত রোগে ভুগে গতপরশু মঙ্গলবার রাত ১২টার দিকে ঢাকাস্থ ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, ২ ছেলে ও ১ মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় আলমডাঙ্গা দারুস সালাম কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মরহুমের লাশ দাফন করা হবে। বেশ কিছুদিন আগেই কাজী কামালকে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসাধীন রাখা হয়েছিলো। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার অবস্থার অবনতি হলে ওই হাসপাতালেই তাকে আইসিইউ-তে রাখা। পরে তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ছাড়পত্র দিয়ে দেয়। পরে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

পারিবারিকসূত্র জানায়, প্রায় ৭ মাস আগে তার শরীরে প্রেসমেকার বসানো হয়। তার আগে তাকে ওপেনহার্ট সার্জারি করা হয়েছিলো। সম্প্রতি তার শারীরিক অবস্থার আবারও অবনতি হলে ঢাকাস্থ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার হার্টে প্রতিস্থাপিত প্রেসমেকারের স্থানে ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় তাকে হাসপাতালের আইসিইউ-তে রাখা হয়েছিলো। বেশ কয়েক দিনের ব্যবধানেও কোনোভাবেই তাকে আর সুস্থ করা সম্ভব হয়নি। এমতাবস্থায় তার দুটি কিডনিই অচল হয়ে পড়ে। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে ছাড়পত্র দিয়ে দেয়। পরে তাকে ল্যাবএইড হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত মঙ্গলবার রাত ১২টার দিকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

গতকাল বুধবার যাবতীয় আইন-কানুন ও করণীয় শেষে দুপুর ২টার দিকে লাশ আলমডাঙ্গায় নেয়া হয়। রাত ৯টার দিকে লাশ মরহুমের বাবুপাড়াস্থ বাড়িতে পৌঁছায়। এ সময় আলমডাঙ্গার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, মুক্তিযোদ্ধা ও সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের মানুষ তার বাড়িতে ছুটে যায় শেষবারের মতো এক নজর দেখার জন্য। আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৮টায় গার্ড অব অনার প্রদান শেষে সকাল ৯টায় মরহুমের লাশ স্থানীয় দারুস সালাম কবরস্থানে দাফন করা হবে।

উল্লেখ্য, আলমডাঙ্গা উপজেলার পার্শ্ববর্তী মিরপুর উপজেলার সুতাইল গ্রামের মৃত কাজী সিরাজুল ইসলামের ছেলে কাজী কামাল। ৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তিনি। আলমডাঙ্গা থানা মুজিব বাহিনীর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। ৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন। ৬৬ সালের গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দেন কাজী কামাল। ৭০ সালে নিজ উদ্যোগে এলাকায় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেন। আব্দুল হান্নান, আশু, মজিবর রহমান, মঈনুদ্দীনসহ প্রথিতযশা বহু ছাত্রনেতা তার নেতৃত্বে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার শিষ্য বলে নিজের পরিচয় দিতে ভালোবাসেন এমন একাধিক মুক্তিযোদ্ধা বলেন- আলমডাঙ্গা রেলস্টেশন থেকে পুলিশের রাইফেল কেড়ে নিয়েছিলেন তিনি। নিজ বাড়িতে রাইফেল ট্রেনিং দিতেন। এসব যুদ্ধের প্রারম্ভের কথা। তারপর যখন যুদ্ধের ডামাডোল বেজে উঠলো তখন তৎকালীন আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা শাফায়েত-উল ইসলাম, ডা. শাহাবুদ্দিনসহ অনেককেই সাথে নিয়ে আলমডাঙ্গা কলেজে কন্ট্রোলরুম তৈরি করেছিলেন। তার অমিত বীরত্বপূর্ণ নেতৃত্বে আলমডাঙ্গা থানার সমস্ত রাইফেল লুট করে স্বেচ্ছাসেবকদের মাঝে বিলিয়ে দেয়া হয়। এ সময় কামাল বাহিনীর শক্তি ও সাহস এতো বেশি হয়ে পড়ে যে তারা মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ও ইপিআর বাহিনীসহ কুষ্টিয়াকে পাকহানাদার মুক্ত করতে মরণপণ যুদ্ধ করেন। আরও ভালো প্রশিক্ষণের জন্য তিনি ভারতে চলে যান সদলবলে। সেখানে ট্রেনিং শেষে দেরাদুনে যান উচ্চ প্রশিক্ষণে। পাহাড়ি অঞ্চলে উচ্চ প্রশিক্ষণ শেষ করেন। পরে দেশে ফিরে যেসব মুক্তিযোদ্ধা ভারতে যেতে পারেননি তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে অনুপ্রাণিত করতেন। কাকিলাদহের যুদ্ধে তিনি কমান্ডিঙের দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় তিনি পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। ব্যক্তি জীবনে তিনি অত্যন্ত সহজসরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে তার ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক ছিলো। তিনি কাজী কামালকে তৎকালীন থানা গভর্ণর করেছিলেন। স্বাধীনতার পর কুমারী ইউনিয়নের প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি।