ধারালো অস্ত্রের এলোপাতাড়ি কোপে ছাত্রদল নেতা হাসের খুন

মেহেরপুর গাংনীর সেই চরগোয়াল গ্রামে আবারো নৃশংসতা : একের পর এক প্রাণহানি

 

ঘটনাস্থল থেকে ফিরে মাজেদুল হক মানিক: উপ্তত্ত হয়ে উঠেছে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার চরগোয়ালগ্রাম। তিন বছর পর আবারো সেই গ্রামের বাতাসে ভেসে এলো লাশের গন্ধ। এবার দুর্বৃত্তদের ধারালো অস্ত্রের নির্মম আঘাতে নৃশংসভাবে খুন হলেন ছাত্রদল নেতা হাসানুজ্জামান হাসের (৩২)। গতকাল বুধবার সকালে গ্রামের কামারদাঁড় মাঠের সড়কে এ রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। নিহত হাসের ওই গ্রামের সাদিমান মণ্ডলের ছেলে এবং উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এ ঘটনায় গ্রামটি এখন মানুষশূন্য প্রায়। পূর্বশত্রুতার জের ধরে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ পরিবারের।

Gangni Murder pic_01.04.15_ (6)

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গতকাল ফজরের আজানের পর হাসের মোটরসাইকেলযোগে কামারদাঁড় মাঠে তাদের সেচপাম্পের উদ্দেশে রওনা দেন। কীটনাশক স্প্রে মেশিন ও খাবার সাথে ছিলো। জমির কাছাকাছি পৌঁছুলে সড়কের পাশে ঝোঁপের ধারে আগে থেকে ওত পেতে থাকা কয়েকজন তার ওপর হামলা চালায়। ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাকে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে তারা পালিয়ে যায়।

নিহতের পিতা সাদিমান মণ্ডল জানান, গতকাল ভোরে গ্রামের হায়দার আলীর ছেলে রকিবুল মোবাইলফোনে জমিতে সেচ দেয়ার কথা বলে হাসেরকে ডাকে। হাসের মাঠে রওনা দিলে তিনি মসজিদে নামাজ পড়তে যান। নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হলে হত্যার খবর পান। গত কয়েক দিন ধরে গ্রামের কয়েকজন তাকে হত্যার অপচেষ্টা করছিলো বলে পরিবারের লোকজন জানতে পারেন। রাজনৈতিক ও গ্রাম্য বিরোধের জের ধরে তার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানান তিনি। কয়েকজন অভিযুক্ত হত্যাকারীর নামও বলেন নিহতের পিতা।

Gangni Murder pic_01.04.15_(1)

ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, কামার দাঁড়ের মাঠের মাথাভাঙ্গা মরা নদীর পাশ দিয়ে মেঠো রাস্তার ওপর পড়ে ছিলো হাসেরের ছিন্ন-ভিন্ন ক্ষত-বিক্ষত নিথর দেহ। পাশেই ছিলো রক্তমাখা মোটরসাইকেল ও সেচকাজে ব্যবহৃত কৃষি যন্ত্রপাতি। একটি হাত ব্যাগে সকালের খাবার। চারদিকে ঘিরে আছে স্থানীয় লোকজন। স্বজনদের বুক ফাটা কান্নায় ভারী হয়ে পড়েছে সেখানকার পরিবেশ। খুনের নৃশংসতায় আতঙ্কিত গ্রামবাসীসহ উৎসুক মানুষ। শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের ক্ষত-বিক্ষত চিহ্নই বলে দেয় কতোটা রাগ থাকলে এভাবে খুন করা যায়। মরদেহ এক নজর দেখেই আতকে উঠছেন উৎসুক জনতা।

চলন্ত মোটরসাইকেল থামিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করছে পুলিশ। ঘটনাস্থল প্রাথমিক তদন্ত করে গাংনী থানার ওসি আকরাম হোসেন জানান, হাসের ঘটনাস্থলে পৌঁছুলে তাকে বাধা দেয়া হয়। এ সময় তিনি মোটরসাইকেল স্যান্ড করিয়ে স্টার্ট অবস্থায় রেখে দৌঁড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। তখন দুর্বৃত্তরা পেছন থেকে তাকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। এক পর্যায়ে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েন তিনি। মোটরসাইকেল ও স্প্রে মেশিনসহ তার কাছে থাকা বিভিন্ন জিনিসপত্রে রক্তের দাগ তেমন সাক্ষ্যই বহন করে।

মামলার সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছেন গাংনী থানার ইন্সপেক্টর (ওসি তদন্ত)। তিনি জানান, হাসেরের দেহের বিভিন্ন স্থানে অনেকগুলো কোপের দাগ রয়েছে। মাথার পেছনের দিকের কোপ মারাত্মকভাবে জখম করে। কোমরের ওপরে কোপে নাড়িভুড়ির কিছু অংশ দেহের বাইরে চলে আসে। ডান পায়ের গোড়ালির ওপরের কোপটি এতোটাই প্রবল ছিলো যে হাড়-মাংস ভেদ করে পা শুধু চামড়ায় ঝুলে ছিলো। অর্থাৎ পা থেকে গোড়ালি আলাদা হওয়ার উপক্রম। বাম পায়েও রয়েছে মারাত্মক জখম। এছাড়াও তার পিঠেও বেশ কয়েকটি কোপের দাগ পাওয়া গেছে। ডাক্তারি পরীক্ষায় এগুলো ফুটে উঠেছে। গুলি কিংবা অন্য কিছুর উপস্থিতি নেই।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন বিষয় নিয়েই হাসের ও তার পক্ষের লোকজনের সাথে গ্রামের একটি পক্ষের চরম বিরোধ চলছিলো। ২০১১ সালে দু পক্ষের সংঘর্ষের সময় আওয়ামী লীগ কর্মী ইলিয়াছ প্রকাশ্যে বোমাঘাতে খুন হন। পরের বছর যুবলীগকর্মী আতাহার আলী ও আওয়ামী লীগ সমর্থক হাবেলকে গুলি করে কুপিয়ে খুন করা হয়। ইলিয়াছ হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত প্রধান আসামি এবং অপর হত্যাকাণ্ডের চার্জশিটভুক্ত আসামি ছিলেন হাসের। দুটি মামলায় তিনি দীর্ঘদিন হাজত খেটেছেন। ইলিয়াছ হত্যা মামলাটি স্থানীয়ভাবে মীমাংসা হয়েছে। তবে মামলা দুটি এখনও আদালতে বিচারাধীন। বিএনপির জাভেদ মাসুদ মিল্টন পক্ষে ওই গ্রামের নেতাকর্মীদের নেতৃত্ব দিতেন তিনি। তাছাড়া সামাজিক ও গ্রাম্য দলাদলির বিষয়ে প্রতিপক্ষের রোষানলে ছিলেন। সব মিলিয়ে তাকে পূর্ব পরিকল্পিতভাবেই হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি পরিবারের।

গতকাল সকালে মেহেরপুর সহকারী পুলিশ সুপার (সার্কেল) ও ৱ্যাবের একটি দল ঘটনাস্থল পরির্দশন করেন। মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল সন্ধ্যায় গ্রামে দাফন করা হয়েছে। পরিবার ও স্বজনদের মাঝে বিরাজ করছে শোকের ছায়া। লুটপাটের আশঙ্কায় গ্রামের অনেকেই বাড়ির মালামাল ও গবাদি পশু নিয়ে বাড়ি ত্যাগ করে অন্য গ্রামে আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে উঠেছেন। প্রায় জনশূন্য গ্রামটিতে গতরাতে অনেকটাই ভুঁতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করছিলো। তবে গ্রামের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। গ্রামটিতে যাতে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বজায় থাকে এবং জানমালের নিরাপত্তায় গতরাত থেকে একটি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে বলে জানান ওসি আকরাম হোসেন।

নিহতের পরিবার ও স্বজনদের পাশাপাশি বিএনপির পক্ষ থেকে নিন্দা, প্রতিবাদ ও হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতারপূর্বক শাস্তি দাবি করা হয়েছে। বামন্দী ইউপি চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা আব্দুল আওয়াল গতকাল এক বিবৃতিতে ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন, হত্যাকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনা না গেলে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা হারাবে জনগণ। গতরাত পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে মামলা দায়ের হয়নি। আটক হয়নি কোনো অভিযুক্ত খুনি। আজ বৃহস্পতিবার থানায় মামলা দায়ের করা হতে পারে। ঘটনার পর খুনিদের কয়েকজন চিহ্নিত হয়েছে। তাদের গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান অব্যহত রয়েছে বলে জানান গাংনী থানার ওসি।

হাসরের পারিবারিক পরিচয়: মেহেরপুর গাংনীর চরগোয়াল গ্রামের সাদিমান মণ্ডল ও ছাহেরা খাতুনের চার ছেলের মধ্যে হাসানুজ্জামান হাসের তৃতীয়। হাসেরের বড় ভাই মনিরুল, মেজ ভাই জাকির ও ছোট ভাই সাজু। সকলেই কৃষিকাজ করেন। তিন বোন বিবাহিতা। হাসের অবিবাহিত। পরিবারের নেতৃত্ব ও উপার্জনসহ সব বিষয়েই হাসের ছিলেন সবার হাতের লাঠি। তাই তাকে হারিয়ে পরিবারের লোকজন এখন পাগল প্রায়।

শোকাহত পরিবার যা বললো: হাসরের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে বেদনাবিধুর পরিবেশ। শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছে মা ছাহেরা খাতুন। বোন আশরাফন নেছা বিলাপ করে বলছিলেন শত্রুতা করে এর আগে বাড়ি ঘর ভাঙচুর করে সব কিছু লুট করেছে তাতেও তারা দমেনি। এখন ভায়ের জীবনটা নিয়ে নিলো প্রতিপক্ষরা। হত্যাকারীদের গ্রেফতারপূর্বক শাস্তির দাবি করেন তিনি।

Leave a comment