স্টাফ রিপোর্টার: ইসলামবিরোধী লেখা লেখির কারণে এক যুবকের নির্দেশে কিলিং হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় মাদরাসার তিন ছাত্র! ধর্মীয় উগ্রবাদীদের হাতে খুন হয়েছেন আরেক ব্লগার। নিহতের নাম ওয়াশিকুর রহমান বাবু (২৭)। গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের দক্ষিণ বেগুনবাড়ি এলাকায় বাসার ৪০ গজ দূরে তিন দুর্ববৃত্ত তাকে ধারালো চাপাতি দিয়ে নৃশংসভাবে কুপিয়ে খুন করে। ঘটনা ঘটিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় জনতার হাতে ধরা পড়েছে দু দুর্বৃত্ত। তারা হলো মাদরাসা ছাত্র জিকুরুল্লাহ ও আরিফুল ইসলাম। পুলিশের কাছে তারা হত্যার কথা স্বীকার করে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় ব্লাগার অভিজিৎ রায় ও ২০১৩ সালে মিরপুরে ব্লাগার রাজীব হায়দারকে এভাবেই খুন করা হয়। পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ওয়াশিকুর মতিঝিল অফিসে যাওয়ার জন্য বের হন। এ সময় দুর্বৃত্তরা তাকে কুপিয়ে খুন করে। অনলাইনে নিজের মতাদর্শ প্রচার করাকে কেন্দ্র করে এ খুনের ঘটনা ঘটেছে। হত্যাকাণ্ডে তিনজন অংশ নেয়। এদের মধ্যে আবু তাহের নামে একজন পালিয়েছে। দুজনকে আটক করা হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে দুটি ও আটক আরিফুলের কাছে থাকা ব্যাগ থেকে একটি চাপাতি উদ্ধার করা হয়েছে। আটক দুজন স্বীকার করে বলেছে, ওয়াশিকুর ব্লগার ছিলো। ইসলাম ধর্মবিরোধী লেখালেখি করতো। এ কারণে মাসুম নামে এক যুবকের নির্দেশে তারা ওয়াশিকুরকে হত্যা করেছে। বিকালে শিল্পাঞ্চল থানা থেকে তাদের ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের মিন্টো রোড কার্যালয়ে পাঠানো হয়। সিআইডির ক্রাইম সিন ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করে এবং ওয়াশিকুরের ব্যবহৃত ল্যাপটপটি জব্দ করে ঘরটি তালা মেরে রেখেছে পুলিশ।
পুলিশ জানায়, ওয়াশিকুর রহমান ৪/৩-এ ভবনের দ্বিতীয় তলায় একটি কক্ষে সাবলেটে থাকতেন। সাথে তার বাবা টিপু সুলতানও থাকেন। তাদের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ থানার উত্তর হাজিপুরে। ওয়াশিকুর মতিঝিলের ফারইস্ট অ্যাভিয়েশন নামে একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে ট্রেনি অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
ওয়াশিকুরের বাবা টিপু সুলতান জানান, ওয়াশিকুর তার একমাত্র ছেলে। বড় মেয়ে বিয়ে করে সংসার করছে। ছেলেকে নিয়ে তিনি দক্ষিণ বেগুনবাড়ি সাবলেটে থাকতেন। ওয়াশিকুর রাজধানীর তেজগাঁও কলেজ থেকে মার্কেটিং বিভাগে ২০১৩ সালে অনার্স শেষ করেছে। টিপু সুলতান দৈনিক বাংলার মোড়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। সোমবার সকাল পৌনে ৬টায় তিনি (টিপু সুলতান) গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরে যাওয়ার উদ্দেশে বাসা থেকে বের হন। তখন ওয়াশিকুর বাসায় ঘুমাচ্ছিলো। তিনি লক্ষ্মীপুর পৌঁছানোর পর বেলা সাড়ে ১০টার দিকে মোবাইলফোনে ছেলে হত্যার খবর শোনেন। প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, অফিসের উদ্দেশে সকাল সাড়ে ৯টার একটু আগে বাসা থেকে বের হন ওয়াশিকুর। বাসা থেকে ৪০ গজ দূরে যেতেই দুর্বৃত্তরা তার মুখে, গলায় ও মাথায় এলোপাতাড়ি কোপায়। তিনি মাটিতে পড়ে ছটফট করেন। এ সময় স্থানীয় লোকজন দুর্বৃত্তদের দেখে ধাওয়া করে। দুটি রক্তাক্ত চাপাতি ফেলে দিয়ে দুর্বৃত্তরা দৌড় দেয়। তাদের সবার পিঠে স্কুল ব্যাগ ছিলো। একপর্যায়ে দুজনকে জনগণ আটক করে। পালিয়ে যায় অপরজন। ঘটনাস্থল থেকে আনুমানিক তিনশ গজ দূরে শিল্পাঞ্চল থানার পুলিশ টহল ডিউটিতে ছিলো। টহলে থাকা এএসআই হুমায়ন কবীর বলেন, লোকমুখে খবর শুনে আমাদের তিনটি টিম ছুটে যায়। জনগণের সহায়তায় দুজনকে আটক করা হয়। এএসআই আরও বলেন, তিনি ওয়াশিকুরকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। তাকে উদ্ধারের সময় তার শ্বাস-প্রশ্বাস চলছিল বলে তিনি জানান। সকাল সাড়ে ১০টায় হাসপাতালের চিকিৎসক ওয়াশিকুরকে মৃত ঘোষণা করেন।
আই অ্যাম অভিজিৎ: মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর পর ওয়াশিক ২৬ ফেব্রুয়ারি তার এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছে, এক থাবাবাবার মৃত্যু হাজার থাবাবাবা জন্ম দিয়েছে। এক অভিজিৎ রায়ের মৃত্যু লাখো অভিজিৎ রায়কে জন্ম দেবে। কলম চলবে, চলতেই থাকবে। তোদের বিশ্বাসের মৃত্যু না ঘটা পর্যন্ত… তার ফেসবুকের কভার পেজে আই অ্যাম অভিজিৎ ও প্রোফাইল পিকচারেও আই অ্যাম অভিজিৎ লেখা ছিলো। এছাড়াও ইসলাম ও মুসলমান নিয়ে নানা আপত্তিকর মন্তব্য ও পোস্ট তার ব্লগ এবং ফেসবুক স্ট্যাটাসে ছিলো।
ঘটনাস্থলের বর্ণনা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের কথা: দক্ষিণ বেগুনবাড়ির দীপিকার মোড় থেকে মসজিদের পাশ দিয়ে ভেতরে চলে গেছে সরু রাস্তা। ঘিঞ্জি এলাকা। ঘটনাস্থলের দু পাশে আনুমানিক ৩০ গজের মধ্যে বেশ কয়েকটি দোকান। এছাড়া ঘটনাস্থলের পাশেই আবাসিক ভবন। ঘটনার সময় দোকানগুলো খোলা ছিলো। রাস্তার একপাশে ওয়াশিকুরকে কোপায় দুর্বৃত্তরা। তাকে কুপিয়ে দুটি চাপাতি মাথার পাশে ফেলে রেখে যায় তারা। রুমানা নামে এক নারী বলেন, তিনি একটি মেসে রান্নার কাজ করেন। প্রতিদিনের মতো সোমবার সকালে তিনি ওই মেসে রান্না করতে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হন। রুমানা বলেন, আমি ওই গলিতে ঢুকছি (ঘটনাস্থল যে গলিতে) এমন সময় দেখি একটি ছেলেকে দুজন কোপাচ্ছে। একটু দূরে একজন দাঁড়িয়ে। ছেলেটা চিৎকার করতে করতে মাটিতে পড়ে যায়। আমি মনে করি ওরা ছিনতাই করছে। চোর চোর বলে আমি চিৎকার দিই। এরপরই ওরা পালিয়ে যায়। আমিও পেছন পেছন দৌড় দিই। প্রত্যক্ষদর্শী রফিক হোসেন বলেন, আমি মসজিদের পাশে একটি হোটেলে নাস্তা করছিলাম। চিৎকার শুনে বেরিয়ে দেখি তিনজন পালাচ্ছে। আমি ওদের ধরার জন্য দৌড় দিই। আমার সাথে আরও কয়েকজন দৌড় দেয়। কিছুক্ষণ পর দুজনকে ধরি। তখন পুলিশও আমাদের পেছন পেছন আসে। পুলিশ তাদের আটক করে নিয়ে যায়। একজন পালিয়ে যায়।
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার এসআই হাবিবুর রহমান লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। তাতে তিনি উল্লেখ করেন- মাথার পেছনের নিচের অংশে দু ইঞ্চি লম্বা কাটা দাগ। নাকের ওপরে কাটা চিহ্ন, যা ১০ ইঞ্চি লম্বা ও গভীর দেড় ইঞ্চি। কাটা চিহ্নটি নাক থেকে দুই চোখের মাঝখান দিয়ে দুই কানের কাছাকাছি পর্যন্ত। সেখানে একাধিক কোপ মারায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। তার দুই চোখ কোপে গলে গেছে। থুঁতনির মাঝখানে চার ইঞ্চি লম্বা কাটা দাগ। এর গভীরতা দেড় ইঞ্চি। গলায় দুটি কাটা দাগ, একটি কোপ তিন ইঞ্চি ভেদ করে শ্বাসনালি কেটে গেছে। গলার ওপরের কাটা দাগ দুই ইঞ্চি। গলার নিচের অংশে কালো তিনটি দাগ আছে। ডান গালে চার ইঞ্চি লম্বা এবং এক ইঞ্চি গভীর কাটা দাগ। এদিকে সন্ধ্যায় মর্গে লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়। রাতে গ্রামের উদ্দেশে লাশ নেয়া হয়।
আটক দুজনের পরিচয়: পুলিশ জানিয়েছে, জিকুরুল্লাহ চট্টগ্রামের হাটহাজারি মাদরাসার তাফসির বিভাগের ছাত্র। তার বাবার নাম মইনুদ্দিন। গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরের গজারিয়াকান্দি। তবে জিকুরুল্লাহ মাদরাসায় থাকতেন। হাটহাজারী মাদরাসা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জিকুরুল্লাহ তাদের মাদরাসার ছাত্র নন। আরিফুল ইসলাম মিরপুর-১ নম্বরের দারুল উলম মাদরাসার ছাত্র। তার বাবার নাম তাজুল ইসলাম। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার তিতাস থানার বারকাউলিয়ায়। পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা হত্যার কথা স্বীকার করে জানিয়েছে- অনলাইনের মাধ্যমে ঢাকার মাসুম নামে এক যুবকের সাথে তাদের পরিচয় হয়। মাসুম তাদের জানায়, ওয়াশিকুর ইসলামবিরোধী লেখালেখি করে। তাকে হত্যা করতে হবে। ওয়াশিকুরকে হত্যার উদ্দেশ্যে গত শনিবার হাটহাজারি থেকে ঢাকায় আসে জিকুরল্লাহ। রোববার রাতে যাত্রাবাড়ী একটি মসজিদে ছিলো জিকুরুল্লাহ। ওইদিন বিকালে হাতিরঝিলে মাসুম, জিকরুল্লাহ, আরিফুল ও তাহের মিলিত হয়ে ওয়াশিকুরকে হত্যার পরিকল্পনা করে। এ সময় ৩ জনের হাতে ৩টি চাপাতি তুলে দেয় মাসুম। সন্ধ্যায় ওয়াশিকুরের বাসার এলাকা রেকিও করে তারা।
আসকের নিন্দা: ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যাকাণ্ডে তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। সোমবার এক প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ব্লগার অভিজিৎ রায়ের হত্যার কিছুদিনের মাথায় আরেক ব্লগার ওয়াশিকুর হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত উদ্বেগের। অবিলম্বে এ ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানায় আসক।
গণজাগরণ মঞ্চের বিক্ষোভ: এদিকে ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সোমবার সন্ধ্যায় শাহবাগে বিক্ষোভ করেছে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা। তারা হত্যাকারী ও তাদের গডফাদারদের গ্রেফতার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। এছাড়াও গণজাগরণ মঞ্চ এক বিবৃতিতে প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
ওয়াশিকুর রহমান তুষার নিহতের ঘটনায় তার গ্রামের বাড়ির লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলার ৫নং চণ্ডিপুর ইউনিয়নের উত্তর হাজীপুর গ্রামের আবদুল করিম হাজীর বাড়িতে চলছে শোকের মাতাম। খুনের খবর ছড়িয়ে পড়লে জনসাধারণের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে।
স্থানীয় সূত্র ও নিহত ওয়াশিকুর রহমানের বোন আসরাফী সুলতানা সিমু জানান, দুই ভাই-বোনের মধ্যে ছোট ভাই ওয়াশিকুর রহমান ছোটবেলা থেকে শান্ত স্বভাবের ছেলে ছিলো। কোনো রাজনীতির সাথে সে জড়িত ছিলো না। তবে সে বিভিন্ন ব্লগে লেখালেখি করতো। ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান ২০০৪ সালে উপজেলার চণ্ডিপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় পাস করে ঢাকায় তেজগাঁও কলেজে গিয়ে ভর্তি হয়।