প্রযুক্তির কাঁধে ভর দিয়ে মানুষ অনেক কিছুই করায়ত্ত করেছে। একের পর এক জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ডানায় ভর করে মানুষ নিজেকে ও ব্রহ্মাণ্ডকে জানার ক্ষেত্রে কথিত ধৃষ্টতায় ধাতস্থ হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। তবে আধুনিকতার বার্তাবাহী প্রযুক্তির নানা প্রকরণকে মানুষ ব্যবহার করলেও সেসব যে ব্যবহারে শুধু সুখই মেলে না, এতে অসুখও ছড়িয়ে পড়তে পারে, তা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে ক’জনাই-বা খবর রাখেন।
শুধু কি ই-বর্জ্য? রাস্তার পাশে যেখানে সেখানে বাড়ির উচ্ছিষ্ট ফেলে চুয়াডাঙ্গার মতো ছোট শহরকেও নোংড়া করে তুলছি। এ যেন নিজেদের শহরকে নিজেদেরই নোংড়া করার নীরব প্রতিযোগিতা। এসবের পাশাপাশি শুধু টিভি, ক্যামেরা, ফ্রিজ, ওভেন, কম্পিউটার, মোবাইল, এয়ারকন্ডিশনার, ওয়াশিং মেশিন, ডিভিডি প্লেয়ার, সিভিটি বাল্বের মতো পণ্যগুলো জীবনকে সহজ করার কাজে ব্যবহার করতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি, কার্যকারিতা হারানো বা নষ্ট হওয়ার পর এগুলো কী করবো, কোথায় ফেলবো তা আমাদের অনেকেরই জানা নেই। ফলে বাতিল হওয়া এসব আধুনিক প্রযুক্তির উপকরণ অনেকেই অন্যান্য নিত্যবর্জ্যের সাথে ফেলে দিই। ই-বর্জ্যের সাথে থাকা সিসা, পারদ, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়ামসহ বিভিন্ন ক্ষতিকারক ধাতু পরিবেশের সাথে মিলে গিয়ে যে খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে চর্মরোগ, শ্বাসকষ্ট, স্নায়ুরোগ এমনকি ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়, সে সম্পর্কে ক’জন বাংলাদেশিই-বা সচেতন! যদি আমাদের মধ্যে সচেতনতা কাজ করত তাহলে আমরা এসব ই-বর্জ্য যত্রতত্র ফেলতে পারতাম কি?
নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না, উন্নত দেশের মানুষের অবশ্য ই-বর্জ্য নিয়ে কোনো ঝামেলা নেই। সেখানে এসব বর্জ্য ফেলার নির্দিষ্ট জায়গা রয়েছে। শুধু তাই নয়, নির্দিষ্ট ইলেকট্রনিক্স ও ইলেকট্রিক কোম্পানি তাদের উৎপাদিত পণ্য মেয়াদ শেষে ফেরত নিয়ে কিছু মূল্য ফেরত দেয়া বা নতুন পণ্য নিতে গেলে তার সাথে মূল্য সমন্বয় করার সুবিধা দেয়। আমাদের এখানে উৎপাদক বা তাদের এজেন্সিগুলো এ ধরনের কোনো সুবিধাই দেয় না। বরং উন্নত দেশের মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য রি-সাইক্লিঙের মাধ্যমে আমাদের এখানে বাজারজাত করে থাকে। ফলে এসব পণ্যের আয়ু কম হয় আর এতে আমাদের পরিবেশ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ে। বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ই-বর্জ্য কোথায় ও কীভাবে রি-সাইকেল বা ফেলতে হবে সে সম্পর্কে কোনো ধারণা দেয়ার প্রয়োজনবোধ করে না। শুধু বাজার সম্প্রসারণ তাদের ধ্যান-জ্ঞান। ফলে আমরা যারা এ পণ্যের ক্রেতা তাদের মধ্যে পণ্যটি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর যত্রতত্র ফেলায় স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি পাওয়ার ধারণাটি থাকে না। সরকারও এ ব্যাপারে নাগরিক সচেতনতা সৃষ্টিতে এখনও উদ্যোগী হয়নি। কবে হবে তারও তেমন আলামত এখন পর্যন্ত ফুটে ওঠেনি। নাগরিকদের কিসে ভালো হবে, কিসে মন্দ হবে সে সম্পর্কে সচেতন করার ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব অনেক। পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনেরও এদিকে বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন নয় কি?
সরকার এ ব্যাপারে নীতিমালা চূড়ান্ত করে পাস করার মাধ্যমে ই-ব্যবস্থাপনাকে বিধিবদ্ধ করতে কেন বিলম্ব করছে তা বোধগম্য নয়। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালার সাথে নাগরিকদের এ ব্যাপারে সচেতন করার সরকারি প্রচেষ্টা থাকলে মানুষ যত্রতত্র ই-বর্জ্য ফেলে নিজেরাই নিজেদের স্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবেন না। বিষয়টি জনস্বার্থে গুরুত্ব দেয়া জরুরি। জনসাধারণকেও এ বিষয়ে সচেতন হওয়া দরকার।