‘পক্ষের না হলে প্রতিপক্ষ, আমার না হলে অন্যের’ এরকম ভাবার মতো দলীয় সঙ্কীর্ণতায় আক্রান্ত নেতার সংখ্যা সমাজে নেহায়েত কম নয়। একইভাবে ধর্মান্ধত্বয় উন্মত্ত হয়ে নিজেরটা ছাড়া অন্যেরটাকে কুসংস্কার ভাবা ও কটাক্ষ করা এবং মুক্ত চিন্তার মানুষগুলোকে মানুষ ভাবতে না পারার মতো মানুষ চেনা ধর্মগুলোতেও কম নেই? ধর্মান্ধত্বের হিংস্র আচরণ শুধু সমাজকে আতঙ্কগ্রস্তই করে না, ধর্মীয় অনুশাসনও প্রশ্নের মুখে পড়ে। একইভাবে রাজনৈতিক দলভুক্ত না হওয়া রাজনীতি করা মানুষগুলোকে প্রতিপক্ষ ভেবে দূরে ঠেলে বা চোখ রাঙিয়ে নিজের তোষামোদিদের কাতারে নেয়ার পাঁয়তারাও দলীয় আদর্শকে কলুষিত করে। অবশ্যই সমাজে রাজনৈতিক দলভুক্ত মানুষের চেয়ে রাজনীতি না করার রাজনীতিভুক্ত মানুষের সংখ্যা বেশি। ওরা দলীয় গণ্ডিবদ্ধ না হয়ে মানসিকভাবে বিশাল হলেও দুর্বল। কারণ ওরা সংগঠিত নয়। এরা ভালো থাকতে চায়। ভালো থাকার জন্য মতামতও সুযোগ বুঝে প্রয়োগ করে। এদের প্রদত্ত সিদ্ধান্তেই চূড়ান্ত হয় ক্ষমতার মসনদে বসবে কোন দল। এদের মধ্যে যারা মুক্ত চিন্তায় মুক্ত মনে অবাধ পরিবেশে মতামত দেয়ার গুরুত্বারোপ করে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারাই হয়ে ওঠে প্রতিপক্ষ। যদিও পোশাকি মুক্তমনীরা বিভক্ত। প্রকৃত মুক্তমনের মানুষের কাছে ওরাও ভয়ঙ্কর। পোশাকি নয়, প্রকৃত মুক্তমনের কাউকে প্রতিপক্ষ ভাবার রেওয়াজ থেকে যেমন মুক্ত হয়ে আদর্শের বহুডোরে বাধার সংস্কৃতি গড়ে তোলা দরকার, তেমনই হিংস্রতার বদলে ধর্মের ভালো দিক তুলে ধরে অন্যকে আকৃষ্ট করাই শ্রেয়।
মুক্তমনের লেখক ব্লগার অভিজিৎকে প্রকাশ্যে খুন করা হয়েছে। এ খুন নিয়েও রাজনৈতিক বুলি আওড়ানোর কমতি নেই। এক পক্ষের বক্তব্য পশ্চিমাদের খুশি করতেই এ খুন। অপরপক্ষের মন্তব্য মৌলবাদ জঙ্গিবাদচক্রের কালোথাবা। এসব মন্তব্যের চেয়ে খুনি শনাক্তে দরকার সুষ্ঠু তদন্ত। তদন্ত করে প্রকৃত খুনি ধরে আইনে সোপর্দ করা যেমন জরুরি, তেমনই এ ধরনের খুনিদের প্রশ্রয়ের বদলে প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতাও প্রয়োজন। ইতোমধ্যেই ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুনের হুমকিদাতা একজনকে আটক করা হয়েছে। বেশ কিছু তথ্য উন্মোচিত হয়েছে বলেও দাবি তদন্তকারীদের। উন্মোচিত তথ্যের মধ্যে পত্রপত্রিকায় যেটুকু প্রকাশিত হয়েছে তা চমকে ওঠার মতো। প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি মুক্তমনের কেউই এ দেশে নিরাপদ নয়? কোন দিকে যাচ্ছে সমাজ? শুধু কি আমাদের দেশেই ধর্মান্ধদের উন্মত্ততা? পড়শি দেশে নেই। আছে। এই তো রাজনৈতিক ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পরপরই অন্য ধর্মাবলম্বীদের জোর করে ধর্মান্তর করার খবর সে দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা গোটা বিশ্বের দরবারেই প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। খুন-খারাবির খবরও কি কম? এ কারণেই স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ধর্ম নিয়ে যা হচ্ছে তা থেকে মুক্তির জন্যই মুক্তমনের মানুষগুলো কিছু প্রশ্ন তুলতেই পারে। যুক্তি দেখিয়ে উত্থাপিত কোন প্রশ্ন যদি ধর্মীয় বিশ্বাসের বিপরীতও হয়, তারপরও কি পেশিশক্তি প্রয়োগ প্রশ্রয় পাওয়ার যোগ্য? কখনোই মেধাশক্তির চেয়ে পেশিশক্তি বড় নয়। যদিও পেশিশক্তি বারবারই গোটা সমাজকে বধ করতে চেয়েছে। পেরেছে কি?
ভালো কাজের প্রশংসা নাই-বা করলো, মন্দ কাজের সমালোচনা করা মানে যেমন নিন্দুক নয়, তেমনই সমালোচনায় নিজেকে সুধরে নেয়ার বদলে সমালোচককে প্রতিপক্ষের কাতারে ফেলে চোখরাঙানিও নেতৃত্ব নয়। ধর্মেরও কিছু বিষয় থাকে ধর্মান্ধত্বে তা উপলব্ধি করতে না পারলে মুক্তমনের কারো কাছে তা জিজ্ঞাসা হতেই পারে। সুষ্ঠু জবাব দিতে না পেরে হিংস্রতা দেখিয়ে কতোদিন দমিয়ে রাখা যায়। অবশ্যই প্রশ্ন উঠতে পারে- উপাসনালয় জনসংখ্যার ঘনত্ব বুঝে স্থাপন করতে হবে নাকি দূরত্ব ভেদে? সেই দূরত্ব মাপার উপায় কি? পরিশুদ্ধ বলে দাবি করা ধর্মেও তা স্পষ্ট। এরপরও ক’জন সেদিকে নজর রাখছেন? বিরোধপূর্ণ জমিতেই শুধু লেখনি ঝুলিয়েই নয়, সুযোগ বুঝে খাস জমিতেও গড়ে তোলা হচ্ছে ধর্মপালনের ইমারত। আর আহ্বানের আওয়াজ? সে ঘণ্টা, ঢাকেরই হোক বা মাইকের- তা কতোটা চড়া হবে, নাকি শ্রবণে কতোটা মধুর হবে তাও কি- দিনের পর দিন উপলব্ধির উপেক্ষায়-ই থেকে যাবে? মুক্তমনের এমন কিছু মানুষ আছে তাদের কেউ অধিকার খর্বের উপলব্ধি থেকে এসব নিয়ে প্রশ্ন তুললে তাকে যুক্তিবাদী নাকি নাস্তিক বলে কীভাবে দমানো যায় তা নিয়ে মাতামাতি কতোটা যুক্তির? হিংস্রতার চেয়ে সঠিক পদক্ষেপই কি ধর্ম নির্দেশ করে না? অন্যের অধিকার তথা স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই নিজের অধিকার ভোগ করার মানসিকতা গড়ে তোলা যেমন দরকার, তেমনই দরকার পেশিশক্তির বদলে মেধাশক্তি প্রয়োগের পথে হাঁটা।
পুনশ্চ: শান্তির প্রথম শর্ত সম্প্রীতি। উন্নয়নেও। শুধু সাম্প্রদায়িকতাই নয়, সর্বক্ষেত্রেই সম্প্রীতি অনিবার্য।