স্টাফ রিপোর্টার: দৃশ্যমান তৎপরতায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ঢাকার কূটনৈতিক পাড়া। চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা, আন্দোলনরত ২০ দলের নেত্রী এবং জাতীয় পার্টির সাথে পৃথক পৃথক বৈঠক করে সর্বোচ্চ কূটনৈতিক ভাষায় পরিণতি ভাবার জন্য তারা সর্তকবাণী দিচ্ছেন। বাংলাদেশের সর্বশেষ তথ্য নিয়মিত নিজ নিজ রাষ্ট্রে পাঠাচ্ছেন। পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকায় কর্মরত বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা দফায় দফায় অনির্ধারিত বৈঠকও করছেন নিজেদের মধ্যে। নিয়মিত খোঁজখবর ছাড়াও নিজেদের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করছেন। সরকারের পক্ষ থেকে এসব তৎপরতাকে রুটিন বৈঠক বলা হলেও বৈঠকে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের আলোচনাই যে একমাত্র বিষয় এটা আর গোপন থাকছে না। সর্বশেষ গতকাল গত বুধবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাংলাদেশস্থ প্রতিনিধি দেখা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে। তিনি অবিলম্বে সংলাপের উদ্যোগ নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। একই দিনে ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন বৈঠক করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ২০ দলীয় জোটের নেত্রী খালেদা জিয়ার সাথে। আলোচনায় বৈঠকে বসতে বাধ্য করার জন্য এরা কিছুটা ধমকের সুরেও কথা বলছেন। গত বুধবার বৈঠক শেষে কূটনৈতিক আচরণের সর্বোচ্চ কড়া ভাষায় ব্রিটিশ এ রাষ্ট্রদূত বলেছেন, সকল রাজনৈতিক দল ও নেতা-নেত্রী যেন তাদের কর্মের পরিণতি সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে ভাবেন। এ সময় তিনি আরো বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আস্থা বৃদ্ধির জন্য দীর্ঘ মেয়াদে আলোচনা করা দরকার। যা আগেও আমি বলেছি। তাহলেই বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সহিংসতা ও বিঘ্ন সৃষ্টির যে রাজনৈতিক আচরণ গড়ে উঠেছে তার বিলুপ্তি ঘটবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সাথেও তারা বৈঠক করেছেন। এদিকে বাংলাদেশে এসেই চোখে পড়ার মতো কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন নবনিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেন্স ব্লুম বার্নিক্যাট। ইতোমধ্যে তিনি বৈঠক করেছেন সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতের সাথে। ভারতে অনুষ্ঠিত হলো দেশটির বিদেশে কর্মরত রাষ্ট্রদূতদের বার্ষিক কনফারেন্স। সেখানেও ঢাকার চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের বিষয়ে বাংলাদেশস্থ ভারতীয় হাইকমিশনার সেদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ব্রিফ করেছেন। অতীতে দেখা গেছে, বাণিজ্যিক ও ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর বিশ্বের নজর একটু বেশিই থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমানের এ কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু হলো বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও সঙ্কটের শুরুর দিকে তারা শুধুমাত্র বিবৃতির মাধ্যমে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। সবশেষে এখন নিজেরা সরাসরি দেখা-সাক্ষাতের মাধ্যমে উভয়পক্ষের ওপর চাপ প্রয়োগ শুরু করেছেন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের চলমান অবরোধের পাশাপাশি চলছে হরতালও। এতে স্থবির হয়ে পড়েছে দেশের প্রায় সব ধরনের অথনৈতিক কার্যক্রম। আমদানি-রফতানি কার্যক্রম নেমে এসেছে শূন্যের কোঠায়। নাগরিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।
সরকার সবকিছু স্বাভাবিক আছে বললেও ক্রমান্বয়ে তাদের স্বীকার করতে হচ্ছে নাজুক ও ভয়াবহ পরিস্থিতিকে। শিগগিরই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে- সরকারের এ কথায় আশ্বস্ত হতে পারছেন না কূটনৈতিক ও ব্যবসায়ীরা। বিজেএমইএ, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইসহ প্রায় প্রতিটি সংগঠনই উভয়পক্ষকে আলোচনায় বসে সমঝোতার আহ্বান জানিয়ে আসছে। এসব সংগঠন নিজস্ব চিন্তার আলোকে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করছে। তবুও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। বিদেশি দূতাবাসগুলো থেকে সেদেশের নাগরিকদের বাংলাদেশে চলাফেরা করার ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। ঢাকার বাইরে যাওয়া বন্ধ রয়েছে তাদের। সতর্কতা জারি করে নিয়মিত চিঠি পাঠানো হচ্ছে সংশ্লিষ্ট জায়গায়। বিদেশি ক্রেতাদের বাংলাদেশে আসার ক্ষেত্রে পরিবেশ-পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে বলা হয়েছে।
রাজনৈতিক সঙ্কটে সবচেয়ে বেশি উৎকণ্ঠায় রয়েছে বাংলাদেশি প্রবাসীরা। দেশ নিয়ে তাদের উৎকণ্ঠার কথা নিয়মিত জানাচ্ছে সে দেশের সরকার ও জাতিসংঘের কাছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে যারা বিদেশি নাগরিকত্ব পেয়েছে তাদের উদ্বেগ নিয়ে বেশি চিন্তিত রাষ্ট্রগুলো। তাদের কথায় সে সকল রাষ্ট্রগুলো ঢাকাস্থ দূতদের মাধ্যমে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিষয়ে নিয়মিত তথ্য নিচ্ছে বলে স্বীকারও করেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী।
উল্লেখ্য, ইতঃপূর্বে দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার বিষয়ে সরকারের ভূমিকা জানাতে বিদেশি দূতাবাস প্রধানদের সাথে ম্যারাথন বৈঠক করেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাহমুদ আলী। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বৈঠক করেন ওআইসি, সার্ক, আসিয়ান ও বিমসটেকভুক্ত সদস্য রাষ্ট্রের দূতাবাস প্রধানদের সাথে। এর মধ্যে কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদিআরব ও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সাথে অনুষ্ঠিত বৈঠককে অতি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হয় কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক মহলে।
বৈঠকের আলোচিত বিষয় তুলে ধরে ২০ জানুয়ারি গণমাধ্যমের কাছে চলমান রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের উৎকণ্ঠা ও কূটনৈতিকদের উদ্বেগের কথা স্বীকার করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী। অনুষ্ঠিত বৈঠকটিতে কূটনৈতিকরা তাদের মতামত ও মূল্যায়ন বাংলাদেশের কাছে তুলে ধরেন।
চলমান সঙ্কট উত্তোরণে কূটনীতিকরা কোন ধরনের সংলাপের প্রস্তাব দিয়েছেন কি-না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী বলেছেন, এটা বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ সমস্যা। আমাদেরকেই সমাধান বের করতে হবে।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীদের সাথে বৈঠক করেছেন কূটনৈতিক মহল। বৈঠকে সরকার ও দলের প্রভাবশালী নেতাদের মধ্যে যোগদান করেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু। বৈঠকে ছিলেন জাতীয় পার্টির নেতা জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী। এ সময় কূটনীতিকদের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
সূত্র জানায়, সে বৈঠকেও কূটনীতিকরা দেশের চলমান সংঘাত ও সহিংস পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সমস্যা সমাধানে সরকার কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে তাদের পক্ষ থেকে। এর আগে ১৫ জানুয়ারি বিএনপির সাথে বৈঠক করেছেন কয়েকটি দেশের প্রভাবশালী কূটনীতিকরা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খানের গুলশানের বাসায় বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকে অংশ নেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন, স্পেন, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, নরওয়ে ও কানাডা দূতাবাসের কর্মকর্তাগণ। বিএনপির পক্ষে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান, ড. আবদুল মঈন খান, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া ও স্বনির্ভর বিষয়ক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু। দেশের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট ও বিরোধী জোটের আন্দোলনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
৪ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে পরিচয়পত্র পেশ করেন বাংলাদেশে নবনিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেন্স ব্লুম বার্নিক্যাট। এ সময় তিনি বলেছেন, আমেরিকা বাংলাদেশকে এ অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে দেখতে চায়। দু দেশের জনগণের স্বার্থে কাজ করার মাধ্যমে আমেরিকা-বাংলাদেশের সম্পর্ককে মজবুত করার ওপর গুরত্বারোপ করেন তিনি। রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাতের আগে ওই দিন সকালে তিনি অনির্ধারিত এক বৈঠক করেন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত পঙ্কজ শরণের সাথে। নতুন মার্কিন রাষ্ট্রদূত অফিসিয়ালি যোগদানের পর থেকেই কূটনৈতিক পাড়ার আসল কার্যক্রম শুরু হয়।
তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, আলোচনা ও সমঝোতার ব্যাপারে সাবেক সিইসি শামসুল হুদা, ড. কামাল হোসেন প্রমুখের নেতৃত্বাধীন নাগরিক সমাজের উদ্যোগ সরকার পক্ষ নাকচ পরই কূটনৈতিক মহল তাদের ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছেন। সবশেষে গতকাল বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ থেকে জানানো হয়েছে যে, স্বয়ং মহাসচিব বান কি মুন বাংলাদেশ বিষয়ে সরাসরি উদ্যোগ নিতে যাচ্ছেন। শিগগিরই এ উদ্যোগ পরিলক্ষিত হবে।