স্টাফ রিপোর্টার: বরিশালের গৌরনদীতে পণ্যবাহী ট্রাকে পেট্রোলবোমা হামলায় আরও তিনজন নিহত হয়েছেন। নারায়ণগঞ্জে বোমা হামলায় অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন ট্রাক চালকসহ দুজন। আহতদের আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। গাইবান্ধায় বাসে বোমা হামলায় হতাহতের পর এবার দুটি ট্রাকে বোমা হামলা হয়েছে। এছাড়া চুয়াডাঙ্গা ও দোহারে অন্তত তিনটি বাস আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের লাগাতার অবরোধ চলাকালে গত ২৪ ঘণ্টায় এসব হামলার ঘটনা ঘটে।
গাজীপুরের বাঘের বাজার থেকে পোল্ট্রি ফিড বোঝাই করে গাড়িটি (ঢাকা মেট্রো-ট-১৬-৯৩২৬) শুক্রবার রাত ৮টার দিকে বরিশালের উদ্দেশে রওনা দেয়। শনিবার সকাল সাড়ে ৫টার দিকে উপজেলার মাহিলাড়া বাসস্ট্যান্ডের দক্ষিণ পাশে হাওলাদার বাড়ির কাছে পৌঁছলে ট্রাকটিতে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করা হয়। এ সময় ট্রাকটিতে আগুন লেগে গেলে চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। সড়কের পাশে একটি মেহগনি গাছের সাথে ধাক্কা লেগে গাড়িটি থেমে যায়। খবর পেয়ে গৌরনদী ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তারা গুরুতর দগ্ধ ট্রাক চালক ইজায়দুল (৩৫), তার শ্বশুর মোতালেব শেখ (৬৫) ও হেলপার মুন্নু বিশ্বাসকে (৩২) উদ্ধার করে গৌরনদী উপজেলা হাসপাতালে পাঠায়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিত্সক তিন জনকেই মৃত ঘোষণা করেন। নিহতদের বাড়ি ফরিদপুরে বলে জানা গেছে।
গৌরনদী থানার ওসি মো. সাজ্জাদ হোসেন জানান, লাশ তিনটি ময়না তদন্তের জন্য বিকেলে বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) জুবায়ের বাদি হয়ে বিএনপির ৩৫ নেতাকর্মীকে আসামি করে মামলা করেছেন। পরে তিন জনকে আটক করা হয়।
স্থানীয় সংসদ সদস্য আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ, অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস, বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি হুমায়ন কবির ও জেলা প্রশাসক শহিদুল আলম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এই নারকীয় হামলার প্রতিবাদে স্থানীয় পেশাজীবীরা দুপুরে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের আশোককাঠীতে মানববন্ধন করেন। একই সময় বিক্ষোভ মিছিল করে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো।
গৌরনদীতে পেট্রোল বোমা হামলায় নিহত ট্রাক চালক ইজায়দুলের বাড়ি জেলার সদর উপজেলার কৈজুরী ইউনিয়নের বদরপুর গ্রামে। তার শ্বশুর নিহত মোতালেব শেখের বাড়ি একই ইউনিয়নের ব্যাংক ডোবা গ্রামে। আর নিহত হেলপার মুন্নু বিশ্বাস ফরিদপুর শহরের বিহারী কলোনীর বাসিন্দা। এই মর্মান্তিক মৃত্যুতে তাদের পরিবারের নেমে এসেছে শোকের ছায়া। গতকাল শনিবার রাতে মরদেহগুলো ফরিদপুরে এসে পৌঁছায়। নিহতদের স্বজনেরা বোমাবাজদের হত্যাকারী আখ্যা দিয়ে তাদের কঠোর শাস্তির দাবি করেছেন।
নিহতদের বাসায় গেলে দেখা যায়, স্বজনরা আহাজারি করছেন। ইজায়দুলের দু শিশুকন্যা ইভা ও ইলা বুঝতে পারছে না কি হয়েছে। ওদের মা রিতা স্বামী ও বাবাকে একসাথে হারিয়ে দিশেহারা। তার আহাজারি থামাতে পারছেন না কেউই। ইজায়দুলের বড় ভাইয়ের স্ত্রী লিপি বেগম বলেন, ‘মোতালেব শেখের আত্মীয়র বাড়ি বরিশাল। হরতাল-অবরোধের কারণে বাসে যাওয়া নিরাপদ না হওয়ায় তিনি সেখানে যেতে পারছিলেন না। ট্রাকে মাল নিয়ে জামাই বরিশাল যাচ্ছে শুনে তিনি রাতে শহরের রাজবাড়ী রাস্তার মোড়ে গিয়ে ট্রাকে উঠেন। তারপর তো সব শেষ।
নিহত মুন্নুর ভাই আব্দুল কুদ্দুস জানান, ১৫ দিন আগে বাড়ি থেকে কাজের সন্ধানে বের হয়েছিল মুন্নু, আজ ফিরলো লাশ হয়ে। তার দুই ছেলে কাজ করে অন্য জেলায়। বড় ছেলে পাপ্পু সিলেটে প্রাইভেট গাড়ি চালায়, ছোট ছেলে হাদি ঢাকায় যমুনা গ্রুপে কাজ করে। ওদের সামান্য আয়ে ওরা নিজেরাই চলে। মুন্নুকে হেলপারি করেই চলতো হতো। এখন তার মৃত্যুতে অসহায় হয়ে পড়লো স্ত্রী পারভীন। এদিকে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো.জহিরুল ইসলাম লাশগুলো দাফনের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিটি পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে সহায়তা দিয়েছেন। রাতেই লাশ দাফন হওয়ার কথা রয়েছে।
গতকাল শনিবার সকাল ৬টার দিকে উপজেলার কাঞ্চন পৌরসভার চাঁন টেক্সটাইল মিল এলাকায় বাইপাস সড়কে একটি চালবাহী ট্রাকে (ঢাকা মেট্রো ট ১৪-৩০২৯) পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে দুর্বৃত্তরা। এতে আগুন লেগে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ট্রাকটি খাদে পড়ে যায়। ট্রাক চালক বাদশা হোসেন (৪০) ও হেলপার হেলাল মিয়া (৩৮) অগ্নিদগ্ধ হন। তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বাদশা নওগাঁ শহরের চকএনায়েত মহল্লার মৃত আব্দুল গফুরের ছেলে। ট্রাকটি ৩শ’ বস্তা চাল নিয়ে নওগাঁ থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছিল।
পলাশবাড়ি উপজেলায় আবারো দুইটি ভুট্টা বোঝাই ট্রাকে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করেছে অবরোধকারীরা। এতে ট্রাকের সামনের অংশ পুড়ে গেলেও কোন হতাহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের উপজেলা সদরের ব্র্যাক অফিস মোড় এলাকায় শনিবার সকাল সাড়ে ৮ টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
গত শুক্রবার রাত ১টার দিকে উপজেলার করম আলী মোড়ে জয়পাড়া পরিবহনের একটি বাস আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। নগরীর আম্বরখানায় মিছিল থেকে গাড়ি ভাঙচুর করেছে শিবির নেতাকর্মীরা। এ সময় তারা অন্তত ৭টি গাড়ি ভাঙচুর করে। গতকাল শনিবার বিকেল ৪টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
টানা অবরোধের ৩৩তম দিন শনিবার বগুড়া, গাইবান্ধা, বরিশালসহ বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা হয়েছে। ১৩ যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। পুলিশ ২০ দলের শতাধিক নেতাকর্মীকে আটক করেছে। রাজধানীর জীবনযাত্রা ছিলো প্রায় স্বাভাবিক। গৌরনদীতে ট্রাকে পেট্রোলবোমা হামলায় ট্রাকচালক, হেলপারসহ ৩ জন নিহত হয়েছেন। গাইবান্ধার তুলসীঘাট বাজারসংলগ্ন বুড়িরঘর এলাকায় শুক্রবার রাতে যাত্রীবাহী নৈশকোচে পেট্রলবোমা নিক্ষেপের ঘটনায় আরও তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এতে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৬ জনে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়ে অবরোধের ৩৩তম দিনে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৭ জনে। চলমান পরিস্থিতিতে যারা বাসার বাইরে বের হচ্ছেন তাদের মধ্যে অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে এমপি আবদুল ওদুদের বাসায় বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। ৱ্যাব নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে ১১ পেট্রলবোমা ও ২ লিটার পেট্রল উদ্ধার করেছে।
চৌদ্দগ্রামে বাসে পেট্রোলবোমায় ৮ যাত্রী নিহতের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। দূরপাল্লার রুটে খুব কম গাড়ি চলেছে। এসএসসি পরীক্ষায় বিভিন্ন স্কুল খোলা থাকায় স্থানীয় পর্যায়ে রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যা অবরোধের অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশি ছিলো। সিডিউল বিপর্যয়ে ট্রেন চললেও যাত্রী ছিলো কম। লঞ্চ চলাচল করেছে নিয়মিতভাবে।