চুয়াডাঙ্গায় আধুনিক কৃষি উপকরণ আর তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার
ফাইজার চৌধুরী: ফেসবুকে আলাপ-আলোচনা আর পরিকল্পনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো ২০১১ সাল। পরের বছর বাস্তবায়ন, তাও খুবই স্বল্প পরিসরে। চুয়াডাঙ্গা শহরের যুবক একিউএম ফিরোজুল হক রিপন এবং ডিঙ্গেদহের আলীমুজ্জামান মিলটনের আধুনিক কৃষি পদ্ধতি ব্যবহার করে চাষাবাদ শুরু সেই থেকে।
শুরুতে পুঁজি বলতে ছিলো দুজনের মোট দু লাখ টাকা, অন্যের কাছ থেকে বর্গা নেয়া ৪ বিঘা জমি, ইন্টারনেট ঘেঁটে এশিয়ার বিভিন্ন স্থানের চাষ পদ্ধতি ও বীজ সম্পর্কে ধারণা নেয়া, আর অদম্য ইচ্ছেশক্তি। এখন অনেকটাই এগিয়ে গেছেন তারা। মাত্র দু বছরের ব্যবধানে জমিতে ফলিয়েছেন অসময়ের তরমুজ, সারা বছরের লাউ, হানিডিউ খরমুজ, থাই পেঁপে, মিষ্টি ভুট্টাসহ আরও বেশ কিছু উন্নত জাতের শাক-সবজি। উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করে এক মরসুমেই লাভ হয়েছে প্রায় ১০ লাখ টাকা। কৃষিক্ষেত্রে চুয়াডাঙ্গার এ দু যুবকের আগ্রহ আর তাদের অত্যাধুনিক চাষ পদ্ধতি, কৃষি উপকরণের ব্যবহার দেখে আশপাশের সাধারণ কৃষকরাও বিভিন্ন পরামর্শ নিতে আসছেন রিপন এবং মিলটনের কাছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসা প্রশাসনে লেখাপড়া শেষ করে চাকরির পেছনে না ছুটে কৃষি নিয়ে মেতে থাকা এ দুজনের স্বপ্ন বাংলাদেশের মাটিতে কম খরচে ফলবে বিদেশি ফসল, সবজি (অসময়ের ফল ও ফসল)। যার বেশ কয়েকটি এরই মধ্যে ভালো ফলন পাওয়া গেছে। এসব ফল বা ফসল বিদেশ থেকে অনেক বেশি মূল্যে আমদানি করতে হয়।
সদর উপজেলার জাফরপুর মাঠে আধুনিক চাষ পদ্ধতিতে তারা প্রথমবারের মতো ব্যবহার শুরু করেছেন কোকোপিট নামক এক বিশেষ ধরনের উপকরণ। চকোলেট রঙের কারণে নয়। কোকোপিটের মূল উপাদান হচ্ছে নারকেলের ছোবড়া বা খোসা নারকেলের কোকোস থেকেই এ নামকরণ। এটি ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ফসলের চারা তৈরিতে। ৫ কেজি ওজনের একটি কোকোপিট পানিতে মেশানোর পর পাওয়া যায় ৫০ কেজি সার জাতীয় উপাদান।
উদ্যোক্তারা জানালেন, একটি দিয়ে অনায়াসে দু বিঘা জমির জন্য প্রয়োজনীয় অসময়ের তরমুজ অথবা থাই পেঁপের চারার সফল অঙ্কুরোদগম ঘটানো সম্ভব। যা আমদানি করতে হয়েছে শ্রীলঙ্কা এবং তাইওয়ান থেকে। কোকোপিটের পাশাপাশি তারা ব্যবহার করছেন মালচিং পেপার, সিড লিং ট্রে, পোকামাকড় আর ভাইরাস থেকে চারা রক্ষা করার জন্য ইনসেক্ট প্রটেক্টটিং নেটসহ আরও বেশ কিছু সরঞ্জাম। দেশীয় বাজারে এসব আধুনিক কৃষি উপকরণ সহজলভ্য নয়। তাইতো এগুলোর সবকটিই আনতে হচ্ছে তাইওয়ান অথবা থাইল্যান্ড থেকে।
অবশ্য চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার গাড়াবাড়িয়া গ্রামের কৃষকরা বেশ কয়েক বছর ধরে মালচিং পেপার ব্যবহার করে অসময়ের তরমুজ চাষে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছেন। তবে তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা রিপন এবং মিলটন মালচিং পেপার ব্যবহারে এনেছেন বেশ কিছু পরিবর্তন। তারা জানালেন, এতে ফসলের উৎপাদন খরচ কম হবে।
মালচিং পেপারের বৈশিষ্ট্য হলো- এটির একপাশ কালো অপর পাশে হালকা রুপালি রঙের। একদম কার্বন পেপারের মতো। যা অতিরিক্ত সূর্যের তাপ আর শৈত্যপ্রবাহ থেকে গাছের গোড়ায় কোনো ক্ষতি হতে দেয় না। তাছাড়া মালচিং ব্যবহারে সেচ, সার প্রয়োজন হয় খুবই অল্প পরিমাণে। আর সিড লিং ট্রে তারা ব্যবহার করছেন চারা তৈরিতে।
৪ বিঘা জমিতে ইতোমধ্যে দুবার চাষ করা হয়েছে অসময়ের তরমুজ। গত শুক্রবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেলো সেখানে আবার কাজ শুরু হয়েছে, জমি মালচিং পেপারে মোড়ানো, বেড তৈরি। এখন প্রস্তুতি চলছে থাই পেঁপে আর নতুন জাতের তরমুজ আবাদের। কোকোপিট, ইনসেক্ট প্রটেক্টিং নেট আর সিড লিং ট্রে ব্যবহার করে প্রস্তুত করা হয়েছে রোগমুক্ত বীজতলা। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা বীজতলার পাশেই শুধু পার্থক্য যাচাইয়ের জন্য সনাতন পদ্ধতিতেও চারা গজানোর ব্যবস্থাও করা হয়েছে। একই জমিতে লাগানো হয়েছে বার মাসি লাউয়ের গাছ আর মিষ্টি ভুট্টা। মাঠের একপাশে পরীক্ষামূলক চাষ করা হয়েছে তিন রঙা ক্যাপসিকামের। তবে এসব ফসল ঘরে তুলতে এখনও ৬৫ থেকে ৭০ দিন অপেক্ষা করতে হবে জানালেন তারা।
মাঠের ফসল সম্পর্কে কোনো তথ্য বা সমস্যা দেখা দিলে দিলে রিপন-মিলটনকে সাহায্য করে ইন্টারনেট। তারা জানালেন, আধুনিক যুগে প্রায় সব ধরনের কৃষি সমস্যার সমাধান বিভিন্ন দেশের কৃষি বিশেষজ্ঞ তাদের ওয়েবসাইটে আপডেট করেন। সেখান থেকে তথ্য নিয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে সাফল্য পাচ্ছেন।
আত্মবিশ্বাসি এ দু যুবক তাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। দুজনের মধ্যে বয়সে বড় রিপন অতীতের কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করলেন। বললেন, শুরুতে কাছের মানুষজনের কাছ থেকে অনেক নেতিবাচক কথা শুনতে হয়েছে। তাতে কষ্টও পেয়েছেন। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন কয়েকবার। তবে তা ছিলো সাময়িক। সব কিছু ঝেড়ে ফেলে নতুন উদ্যমে আবারও মাঠে নেমেছেন। পরীক্ষামূলক চাষ চলাকালীন সময়ে বেশ কিছু ফসলে সাফল্য আসেনি। তাতে কী? আবারও আশায় বুক বেধে, ভুল শুধরে একই ফসল ফলিয়ে এসেছে সাফল্য।
আর মিলটনের কথা, তারা ব্যবসায়িক চিন্তা মাথায় নিয়েই নেমেছেন। তবে সেটি খানিকটা ভিন্ন। আধুনিক পদ্ধতি আর সরঞ্জাম ব্যবহার করে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে অসময়ের ফল-ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি এলাকার কৃষকদের মধ্যে এ প্রযুক্তি ছড়িয়ে দিতে চান তিনি। স্বপ্নবাজ এ যুবক ভূমিকা রাখতে চান এলাকায় আধুনিক চাষ পদ্ধতি প্রসারে। দেশের বড় শহরগুলোর সুপার শপে বিদেশ থেকে আমদানি করা একই প্রজাতির সবজি বা ফল কিনতে এখন যদি ক্রেতাদের খরচ হয় ৩শ টাকা। সেখানে তাদের উৎপাদিত পণ্যের দাম হবে ১শ টাকা। দুজনে মিলে এ কৃষি প্রকল্পের নাম দিয়েছেন এগ্রোল্যান্ড ইন্ট্রিগেটেড ফার্ম।
ফিরোজুল হক রিপন এবং আলীমুজ্জামান মিলটনের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে চাষাবাদ নিয়ে বেশ আগ্রহ দেখিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নির্মল কুমার দে। বিশেষ করে কোকোপিট নামক নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য তাদেরকে অভিবাদন জানানোর পাশাপাশি কৃষি বিষয়ক যেকোনো ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন এ কৃষিবিদ।