চলতি সপ্তাহে আসতে পারে টানা ৪৮ ঘণ্টার হরতাল
স্টাফ রিপোর্টার: চলমান অবরোধে নাশকতা ও সন্ত্রাস দমনে সরকারের নেয়া কোনো পদক্ষেপই আমলে নিচ্ছে না বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। যৌথ বাহিনীর অভিযান, নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-মামলা, নেতাকর্মী এবং সাধারণ মানুষের নিহত ও আহতের ঘটনা, আসন্ন এসএসসি পরীক্ষা এবং দেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব- কোনো কিছুই বিবেচনায় আনছেন না জোটের নেতাকর্মীরা। এমনকি নিজের গ্রেফতারের বিষয়টিও আমলে নিচ্ছেন না বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও। বরং যেকোনো পরিস্থিতিতেই আন্দোলন আরও বেগবান করতে অবরোধের পাশাপাশি মাঝে মধ্যেই হরতাল ডাকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। এরই অংশ হিসেবে চলতি সপ্তায় সারাদেশে কমপক্ষে টানা ৪৮ ঘণ্টার হরতাল আসতে পারে। শুধু তাই নয়, খালেদা জিয়া গ্রেফতার হলে পরবর্তী কর্মসূচি কিভাবে চলবে, সে ব্যাপারেও আগাম দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে নীতিনির্ধারকসহ তৃণমূল নেতাদের। ২০ দলীয় জোটের নীতিনির্ধারণী সূত্রে জনা গেছে এসব তথ্য।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান শুক্রবার বলেন, সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বিএনপি চেয়ারপারসনকে গ্রেফতারের কথা বলা হচ্ছে। তার গ্রেফতার হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সরকার তাকে গ্রেফতার করতে পারে। কিন্তু যৌথ বাহিনীর অভিযান, সারা দেশে নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-মামলা এমনকি নিজের গ্রেফতারের বিষয়টিও আমলে নিচ্ছেন না তিনি (খালেদা জিয়া)। আন্দোলন সফল করাকে চ্যালেঞ্জিং হিসেবে নিয়েছেন তিনি। তার মনোবল অটুট রয়েছে। আন্দোলনকে কিভাবে আরও বেগবান করা যায় সে ব্যাপারে কাজ করতে তিনি আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন।
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করলেই কি আন্দোলন বন্ধ হয়ে যাবে। চলমান সঙ্কটের সমাধান হবে। সরকার হয়তো মনে করছে তাকে গ্রেফতার করলে ভালো হবে। কিন্তু এসব করতে গিয়ে সরকারেরই বেশি অসুবিধা হতে পারে। তিনি বলেন, কাউকে গ্রেফতার করলেই তা বন্ধ হবে না। কারণ আন্দোলন চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। আন্দোলন যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে সেখান থেকে ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। চেয়ারপারসনকে গ্রেফতার করা হলে আন্দোলন আরও বেগবান হবে। নেতাকর্মীরা মনে করবেন, তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে।
মাহবুবুর রহমান আরও বলেন, বর্তমান সংকট আর রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে নেই। এটা এখন সার্বিক বা জাতীয় সংকটে পরিণত হয়েছে। জাতীয় জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে এটা ছড়িয়ে পড়েছে। যারা বার্ন ইউনিটে আছেন তাদের কাছে এটা মনস্তাত্ত্বিক সংকট। তারা আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবেন কিনা সন্দেহ। দেশের এই সংকট থেকে উত্তরণে দুই পক্ষকেই তাদের অনড় অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসন করতে হবে। দেশী এবং বিদেশীরাও একই আহ্বান জানাচ্ছেন।
সূত্র জানায়, গত কয়েকদিনে সংসদ এবং সংসদের বাইরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তাদের শরিকদের কেউ কেউ প্রকাশ্যে খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের আহ্বান জানিয়ে আসছেন। সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীরাও এ বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে বিএনপির নীতিনির্ধারক এবং তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে খালেদা জিয়ার গ্রেফতার নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। তিনি গ্রেফতার হলে পরবর্তীতে আন্দোলনের কৌশল কি হবে তা নিয়েও চলছে আলোচনা। তবে আপাতত বিষয়টিকে কেউ আমলে নিচ্ছেন না। গত কয়েকদিন ধরে দেশের কয়েকটি জেলায় চলা যৌথ বাহিনীর অভিযানকে গুরত্ব দেয়া হচ্ছে না। পাশাপাশি আগামী মাস থেকে শুরু হতে যাওয়া এসএসসি পরীক্ষা নিয়েও কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই তাদের। আন্দোলন যে পর্যায়ে এসে ঠেকেছে সেখান থেকে কোনো কিছুতেই পিছু হটতে চাচ্ছে না দলটি।
সূত্র জানায়, ৩ জানুয়ারি থেকে গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান করছেন খালেদা জিয়া। সেখান থেকে সব ধরনের নিরাপত্তা তুলে নেয়া হলেও কার্যালয় ত্যাগ করেননি তিনি। এখানে বসেই আন্দোলনকে আরও বেগবান ও সক্রিয় করতে কাজ করে যাচ্ছেন। কেন্দ্রীয় ও জেলা নেতাদের দিচ্ছেন নানা দিকনির্দেশনা। আন্দোলনের পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে নেতাদের পরামর্শও নিচ্ছেন তিনি।
তৃণমূল পর্যায়ের কয়েকজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গত কয়েকদিনে দলের চেয়ারপারসন বিভিন্ন জেলা নেতাদের সাথে ফোনে কথা বলেছেন। আন্দোলন নিয়ে কি করা উচিত সে বিষয়ে পরামর্শে চান। সবাই তাকে জানান, এ মুহূর্তে আন্দোলন থেকে সরে আসা ঠিক হবে না। কর্মসূচি স্থগিত করা হলে সরকার আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠবে। দলের সিনিয়র নেতা এমনকি আপনাকেও (খালেদা জিয়া) বিভিন্ন মামলায় সাজা দিয়ে দিতে পারে। সেক্ষেত্রে দলের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে। তাকে গ্রেফতার করা হলেও আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারবেন কি-না- কারও কারও কাছে এ ব্যাপারেও মতামত চান খালেদা জিয়া। তারা খালেদা জিয়াকে বলেছেন, আন্দোলন যে পর্যায়ে রয়েছে সেখান থেকে সরে আসার কোনো সুযোগ নেই। চলমান আন্দোলন আর কিছুদিন চালিয়ে যেতে পারলে একটা ইতিবাচক ফল আসবেই। এখান থেকে পিছু হটা ঠিক হবে না। তাদের এমন পরামর্শ শোনার পর খালেদা জিয়া বলেন, তিনিও এমনটাই চেয়েছিলেন। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলে তিনি তাদের আশ্বস্ত করেন।
দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ জানান, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হলে বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হবে। সরকার মনে করছে তাকে (খালেদা জিয়া) গ্রেফতার করলেই বোধহয় ২০ দলের আন্দোলনে ভাটা পড়বে। কিন্তু তাদের এমন চিন্তা-চেতনা ভুল। আন্দোলন চালিয়ে যেতে দলের চেয়ারপারসনের মনোবল দৃঢ় ও অটুট রয়েছে। যৌথবাহিনীর অভিযান, হামলা-মামলা এতকিছুর পরও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে নেতাকর্মীরা অবরোধ-হরতালে নির্ভীক অগ্রবাহিনী হিসেবে অংশগ্রহণ করছে বলে দাবি করেন তিনি।
জানতে চাইলে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য চট্টগ্রাম মহানগর নেতা মাহবুবুর রহমান শামীম বলেন, আন্দোলন যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে সেখান থেকে সরে আসার কোনো উপায় নেই। কেন্দ্র থেকেও সে ধরনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কীভাবে আন্দোলনকে আরও গতিশীল করা যায় সে ব্যাপারে নানা দিকনির্দেশনাও ইতিমধ্যে তারা পেয়েছেন।
টানা ৪৮ ঘণ্টার হরতাল: বিএনপির নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে, মামলা-হামলা-গণগ্রেফতার উপেক্ষা করে আন্দোলনকে আরও বেগবান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। অবরোধ কর্মসূচি আরও কঠোর করতে আজ-কালের মধ্যেই ঘোষণা আসতে পারে কমপক্ষে ৪৮ ঘণ্টার হরতালের। আন্দোলনের কৌশল হিসেবে কেন্দ্রের নির্দেশে স্থানীয় বিএনপির ডাকে বিভিন্ন জেলায় হরতাল পালিত হচ্ছে। আজ নোয়াখালী ও চাঁদপুরে হরতাল চলছে। কাল রোববার বগুড়ায় টানা ৪৮ ঘণ্টা ও বৃহত্তর চট্টগ্রামে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকা হয়েছে।
সূত্র জানায়, চলতি সপ্তায় অবরোধের পাশাপাশি সারা দেশে হরতাল দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগামী রোববার অথবা সোমবার থেকে কমপক্ষে ৪৮ ঘণ্টা থেকে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত হরতালের ডাক দেয়া হতে পারে। আজ-কালের মধ্যে এ সিদ্ধান্তের কথা গণমাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হতে পারে।