মাথাভাঙ্গা মনিটর: দেশ ও জনগণের স্বার্থে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সাথে চা খেতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমি চা খেতে পছন্দ করি। কাজেই তার সাথে চা তো খেতেই পারি। আমি দেশ ও জনগণের স্বার্থে সব সময়ই নমনীয়। যদিও তিনি চান না, আমি বেঁচে থাকি। তিনি আরো বলেন, সুশীল সমাজই দেশে সংকট তৈরি করছে। তারা চুপ থাকলেই দেশের সংকট কেটে যাবে। আমি দেশে কোনো ধরনের সংকট দেখি না। জাতিসংঘকে বলেছি, আপনারা যতো খুশি পর্যবেক্ষক পাঠান। দেখুন, আমি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারি কি-না। আমি সুষ্ঠু নির্বাচনের গ্যারান্টি দিচ্ছি।
স্থানীয় সময় গত শনিবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচনের লক্ষ্যে বিরোধীদলকে সংসদে গিয়ে প্রস্তাব দেয়ার কথাও বলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, উনি কী চান, সেটা স্পষ্ট করে সংসদে এসে বলুন। তারা তো একবার একটা মুলতবি প্রস্তাব দিয়েছিলো। পরে সেটা তাদের ঝামেলার কারণেই প্রত্যাহার করে নিয়েছিলো। সেটা নিয়ে তো আলোচনা করা যেতো।
বিএনপিকে যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গ ছাড়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গ ছেড়ে আমাদের সাথে এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে একাত্মতা প্রকাশ করুন। দেখবেন সংকট কেটে গেছে। তা না হলে দেখা যাবে, আবারও যুদ্ধাপরাধীদের হাতে পতাকা যাবে। আমাকে ও আওয়ামী লীগকে নিচে নামাতে পারেন। কিন্তু যাকে ওপরে ওঠাচ্ছেন, তারা কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষক।
সংবাদসম্মেলনে শেখ হাসিনা গত ছয় দিনের বিভিন্ন কর্মসূচি ও অর্জন সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন। এ সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. আবদুল মোমেন প্রধানমন্ত্রীর পাশে উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর উল্লেখযোগ্য সফরসঙ্গীরাও উপস্থিত ছিলেন এ সময়। সংবাদ সম্মেলন পরিচালনা করেন মিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি মামুন অর রশিদ।
টানা এক ঘণ্টার সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি বেঁচে থাকি, তা বিরোধীদলীয় নেত্রী চান না। আমার ওপর গ্রেনেড হামলা হয়েছে। তারপরও নমনীয় থেকেছি। তার নিজের ছেলের মাধ্যমে ১৩টি গ্রেনেড ছুড়ে আমাকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছেন তিনি। কোটালিপাড়ায়ও বোমা পোঁতা হয়েছিলো।
শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার দিনটি- যে দিনে আমি আমার মা-বাবা-ভাইদের হারিয়েছি- তিনি বেছে নিয়েছেন জন্মদিনের উৎসব করার জন্য। তার এ উদ্যোগই প্রমাণ করে বিরোধীদলীয় নেতা আমার ভালো চান না। আমি যেদিন শোক পালন করি, সেদিন তিনি মিথ্যা জন্মদিন বানিয়ে কেক কাটেন। পাঁচটি সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার জন্য মিডিয়াকে অভিযুক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ জন্য মিডিয়াও কিছুটা দায়ী। আমরা অনেক ভালো কাজ করেছি। কিন্তু ভালো কাজ করলেও মিডিয়ার কেন এ কৃপণতা? নেগেটিভ নিউজ না করলে পত্রিকা চলবে না- যারা এটা চিন্তা করে খবর ছাপান, তারা সাইকোলজিক্যাল প্রবলেমে ভোগেন। এতে যে দেশের ক্ষতি হয়, এটা তারা ভাবেন না। অনেক সময় গণমাধ্যমে অপপ্রচার চালানো হয়। আমাদের দেশের মানুষ সরলমনা। এসব খবর পড়ে তারা দ্রুত বিভ্রান্ত হয়। পাঁচ সিটিতে আমরা অনেক উন্নয়নকাজ করেছি। আমাদের কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি-সন্ত্রাসের অভিযোগ ছিলো না। তারপরও ভোট পেলো না। কারা জিতলো? যারা যুদ্ধাপরাধের বিচার চায় না। দেশবাসীকে বলতে চাই, ভবিষ্যত চিন্তা করে যেন তারা ভোট দেন। তাৎক্ষণিক সুবিধার কথা যেন তারা চিন্তা না করেন। প্রতিটি নির্বাচনের আগে সমস্যা তৈরি হয়। মিলিটারি শাসন এসেছে। ক্যু হয়েছে। মিলিটারি-ব্যাকড সরকার এসেছে। আমরা এ সমস্যার সমাধান করতে চাই। সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন ও ক্ষমতার হস্তান্তর চাই। কাউকে না কাউকে এটা শুরু করতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, যাদের আপনারা সুশীল সমাজ বলছেন, তারা কেউ আমলা ছিলো, কেউ রাজনৈতিক দল করে ব্যর্থ হয়েছে। যারা সংকট সংকট করছে, তাদের মনের ভেতরে সংকট বেশি। তারাও কোনো না কোনো পদে দায়িত্ব পালন করেছে। তখন তাদের কী ভূমিকা ছিলো, কে কী করেছে, সেটা খুঁজে দেখলেই বোঝা যাবে। এক শ্রেণির লোক দেশে সংকট তৈরি করে। এটা করলে তাদের পোস্ট-পজিশন বাড়ে। তিনি বলেন, এর আগে কোনো সরকারের শেষ তিন মাসে এমন সুষ্ঠু পরিবেশ ছিলো না। সেটা আপনারা বিচার করে দেখতে পারেন। এমনকি কোনো কোনো পত্রিকার মালিকেরও একটা পতাকা পাওয়ার স্বপ্ন ছিলো, সেই আফসোসও আছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বিদ্যুত উৎপাদন করেছি। অনেকগুলো টিভি চ্যানেল ও পত্রিকার অনুমোদন দিয়েছি। এখন সুশীল বাবুদের কথার ফুলঝুরি ছড়ানোর সুযোগ হয়েছে।
আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৬০ আসনও পাবে না- সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের এমন বক্তব্যের ব্যাপারে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। মহাজোট আছে। আর আগামী নির্বাচনেই বোঝা যাবে কে কতো আসন পায়। দেশের জন্য জনগণের স্বার্থে যেকোনো কিছু করতে আমরা প্রস্তুত। ক্ষমতায় এসে নিজের আখের গোছাতে চাই না। আগামীতে ক্ষমতায় গেলে বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ করা ও দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, কোর্ট তো আমাদের হাতে নেই। আইন তার নিজস্ব গতিতেই চলবে। আমি একটি রাজনৈতিক দলের নেত্রী হয়ে আরেকটি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার কথা বলতে পারি না।
রামপালে বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা এটা নিয়ে লংমার্চ করছেন, তারা একবার পায়ে হেঁটে সুন্দরবন ঘুরে দেখুন। মংলা গিয়ে থেমে গেলে হবে না। বাঘ বাঁচলে সুন্দরবন বাঁচবে। যারা আন্দোলন করছেন, তাদের এ বিদ্যুত প্রকল্প সম্পর্কে ধারণাই নেই। সংবাদ সম্মেলনে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড অর্জন, এমডিজি অর্জনে সবচেয়ে অগ্রসর দেশ হিসেবে জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে প্রশংসিত হওয়া এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে উপস্থাপনের সুযোগ পাওয়ার কথা উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ২০১৩ সালের এই ৬৮তম জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন বাংলাদেশের জন্য একটি স্মরণীয় অধিবেশন। ৬৫তম সাধারণ অধিবেশনও বাংলাদেশের জন্য স্মরণীয়।
মনমোহন ও মুনের সাথে বৈঠক: স্থানীয় সময় গত শনিবার দুপুর দেড়টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সাথে বৈঠক করেন। প্রায় আধাঘণ্টা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন তারা। বৈঠক প্রসঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেন, সীমান্ত সমস্যা, সন্ত্রাস দমন ও বাণিজ্য বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠক প্রসঙ্গে ড. আবদুল মোমেন বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতি থাকলে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত হলে, বাংলাদেশ জঙ্গিবাদমুক্ত থাকলে আমরাও স্বস্তি পাই। কারণ সে পরিবেশে জঙ্গি বা সন্ত্রাসীরা বাংলাদেশে অবস্থান নিয়ে ভারতে কিংবা আশপাশের দেশে নাশকতা চালানোর সুযোগ পায় না।’ তিনি জানান, বৈঠকের শুরুতে দু দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এবং স্থায়ী প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকলেও পরে দু নেতা একান্তে কথা বলেন।
স্থায়ী প্রতিনিধি জানান, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী গত চার বছরে বিভিন্ন নির্বাচনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মনমোহন সিংকে জানান, প্রায় সাত হাজার নির্বাচনের একটি নিয়েও কোনো অভিযোগ কেউ করেনি। প্রায় সবকটি নির্বাচনেই প্রধান বিরোধীদল বিএনপির প্রার্থী ছিলো। জবাবে মনমোহন সিং বলেন, স্বচ্ছ, সুন্দর ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তা শুধু বাংলাদেশের জন্যই কল্যাণের হবে না, গণতন্ত্রের সুবাতাস দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশে বিস্তৃত হবে।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী হচ্ছে জেনে মনমোহন সিং সন্তোষ প্রকাশ করেন বলে জানান ড. মোমেন। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের সাথে বৈঠক প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আমার সাথে জাতিসংঘ মহাসচিবের বৈঠক হয়েছে। আমি তাকে বলেছি, আপনারা নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে কি-না দেখার জন্য যতো খুশি পর্যবেক্ষক পাঠান। আপনারা এসে দেখুন, আমরা তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করতে পারি কি না। তত্ত্বাবধায়ক ছাড়াও যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, আওয়ামী লীগ সরকার সেটা দেখিয়ে যেতে চায়।
এ বিষয়ে শেখ হাসিনার বক্তব্যের আগে ড. মোমেন জানান, প্রধানমন্ত্রীর সাথে বান কি মুনের বৈঠকের একটি সফলতা হলো জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিতে রাজি হয়েছে। আরো এক ব্যাটালিয়ন শিগগিরই নেয়া হবে বলে আশ্বাস মিলেছে।
জয়ের লক্ষ্যে কাজ করার আহ্বান: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের জয়ের জন্য কাজ করতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। একই সাথে তিনি বিএনপি-জামায়াত-হেফাজত চক্রের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হতে স্বদেশে তাদের আত্মীয়স্বজনদের উদ্বুদ্ধ করার আহ্বানও জানান। গতকাল রোববার নিউইয়র্কে হোটেল হিলটনে শেখ হাসিনার সম্মানে স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, স্বদেশে আপনাদের আত্মীয়স্বজনদের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের বিজয়ের ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্কবার্তা পৌঁছাতে অনুরোধ করছি। শেখ হাসিনা বলেন, আগামী বছরের মার্চ বা এপ্রিলে বোয়িং কোম্পানি থেকে দুটি উড়োজাহাজ পাওয়া গেলে বিমানের ঢাকা-নিউইয়র্ক ফ্লাইট আবার শুরু হবে।
হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগকর্মীদের জনগণকে এ কথা অবশ্যই বোঝাতে হবে যে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় থাকে, দেশ তখন প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হয়। বিএনপি ক্ষমতায় এলে তা ধূসর হয়ে যায়। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদ, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এবং জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমানের সভাপতিত্বে আরো বক্তৃতা করেন সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদুর রহমান সাজ্জাদ, যুগ্ম সম্পাদক নিজাম চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুর রহিম বাদশাহ ও চন্দন দত্ত। প্রধানমন্ত্রী গতকাল সন্ধ্যায় (যুক্তরাষ্ট্র সময় রোববার সকালে) নিউইয়র্ক ছাড়েন। দুবাই হয়ে আজ সোমবার বিকেল ৫টা ৪০ মিনিটে তার ঢাকায় পৌঁছানোর কথা।