স্টাফ রিপোর্টার: জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের সময়সূচি চূড়ান্ত করতে পারছে না নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কোন সরকার পদ্ধতির অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তা এখনো নির্ধারিত না হওয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সংসদ বহাল রেখে নাকি ভেঙে নির্বাচন হবে তা নিয়ে অস্পষ্টতা থাকায় নির্বাচনের আচরণ বিধি চূড়ান্ত করাও সম্ভব হচ্ছে না। তবে কমিশন সচিবালয় ইতোমধ্যে আচরণ বিধির একটি খসড়া প্রণয়ন করে রেখেছে। এ প্রসঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ বলেছেন, সংসদ এবং রাজনীতিবিদরা আগামী নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে নির্ধারণ করবেন। সংবিধান যেভাবে থাকবে আমরা সেভাবে নির্বাচন আয়োজন করবো।
আগামী জাতীয় নির্বাচন বর্তমান সরকারের (দলীয় সরকার), নাকি অন্তর্বর্তীকালীন, তত্ত্বাবধায়ক এবং সর্বদলীয় সরকারের অধীনে হবে সে বিষয়টি এখনো অমীমাংসিত রয়েছে। আবার নির্বাচন সকল দলের অংশগ্রহণে নাকি বিরোধী দলের বর্জনের মধ্যে হবে তাও স্পষ্ট নয়। তবে সরকারের শীর্ষ মহল থেকে জানানো হয়েছে যে, নির্বাচনকালীন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব পালন করবে। ওই সরকারের একটি ছোট আকারের মন্ত্রিসভা থাকবে। মন্ত্রিসভা দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের বাইরে কোনো কাজে অংশ নেবেন না। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখার কোনো আইনগত রূপ এখনো দেয়া হয়নি।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম চলতি মাসে জানিয়েছিলেন, আইনমন্ত্রী সংসদে অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা উপস্থাপন করবেন। কিন্তু আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ইত্তেফাককে জানিয়েছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো কাঠামো তিনি বা তার মন্ত্রণালয় প্রণয়ন করেনি। সংসদে উপস্থাপনের বিষয়টিও তার জানা নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের পর ড. এটিএম শামসুল হুদা নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন ও স্থানীয় সরকার এই চারটি মন্ত্রণালয় নিয়োগ-বদলি ও পদোন্নতি ক্ষমতা ইসির উপর ন্যস্ত করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বিগত কমিশনের বিদায়ের আগ মুহূর্তে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সংশোধনীর খসড়ায় এই প্রস্তাব দিয়েছিল। পরে আইন মন্ত্রণালয় প্রস্তাবটি বর্তমান কমিশনের কাছে যাচাই-বাছায়ের জন্য ফেরত পাঠিয়ে দেয়। সম্প্রতি মন্ত্রিসভায় আরপিও সংশোধনীর যে প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে তাতে চারটি মন্ত্রণালয় কমিশনের ন্যস্ত করার বিধানটি নেই। প্রসঙ্গত, বিচারপতি খায়রুল হকের রায়ও এই কয়টি মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত করার অভিমত ছিল।
এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নির্বাচনকালীন ছোট আকারের মন্ত্রিসভা থাকবে। সেই মন্ত্রিসভা রুটিন ওয়ার্কের বাইরে কোনো দায়িত্ব পালন করবে না। কিন্তু সংবিধানের ৫৫ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তার কর্তৃত্বে এ সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হইবে। আইন বা আচরণ বিধিতে যাই থাকুক না কেন সংবিধানের এ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতা সংবিধান বিরোধী হবে না। সুতরাং অন্তর্বর্তী সরকারের যে কোন কাঠামো প্রণয়ন করতে হলে সংবিধানের এই বিধানটিকে সংশোধন করতে হবে।
আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট থেকে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। সদ্য গঠিত সমমনা মোর্চা গণফোরাম, বিকল্পধারা, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ-রব), কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগ, নাগরিক ফোরাম বরিশালে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় ঘোষণা দিয়েছে, এই সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচনে তারাও অংশ নেবে না। নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নির্ধারণে বড় দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ওপর আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে। জাতিসংঘ থেকে বলা হয়েছে, সংলাপের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পদ্ধতি বেছে নেয়ার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী আগামী ২৬ অক্টোবর বর্তমান জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন সময়ের মধ্যে প্রবেশ করবে। এ কারণে ২৪ অক্টোবরের পর সংসদের অধিবেশন সমাপ্তি হয়ে যাবে বলে কার্য উপদেষ্টা কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নির্বাচন সংসদ বহাল রেখে হবে নাকি ভেঙে হবে সেটি এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে। সংবিধানের ১২৩ (৩) (ক) অনুচ্ছেদের অধীনে বাংলাদেশে ইতঃপূর্বে কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। ওই অনুচ্ছেদে সংসদের মেয়াদ শেষের পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের বিধান রয়েছে। কিন্তু জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন, সংসদ ভেঙেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ১২৩ (৩) (খ) অনুচ্ছেদে বলা আছে, সংসদ ভেঙ্গে গেলে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের বিধান রয়েছে। সর্বশেষ সচিবদের সাথে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে মন্ত্রীপরিষদ সচিব সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সংসদ বহাল রেখেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য চূড়ান্ত নয়। নির্বাচন কমিশন বললে সংসদ ভেঙে নির্বাচন হতে পারে। ফলে সংসদ বহাল রেখে না বিলুপ্ত করে এই অস্পষ্টতার কারণে নির্বাচন সংসদের মেয়াদের ৯০ দিন আগে বা পরে হওয়া বিষয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন করতে হলে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তার মধ্যে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে হবে। অন্যদিকে সংসদ বিলুপ্ত হলে যেদিন বিলুপ্ত হবে তার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। ফলে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা নিয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে নির্বাচন কমিশন। এ কারণে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিও চূড়ান্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। গত জুলাই মাসে ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা পঞ্চদশ সংশোধনীর আলোকে আচরণ বিধির খসড়া তৈরির কাজ শুরু করলেও সমালোচনার মুখে তা স্থগিত করা হয়েছে। সংসদ নির্বাচনের জন্য আচরণ বিধি প্রণয়ন দফায় দফায় বৈঠক করেও এ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেনি ৫ সদস্যের নির্বাচন কমিশন। তবে সরকার ও সংসদ বহাল রেখে কিভাবে নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা যায় সে বিষয়টির ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। এজন্য ভারত ও ইংল্যান্ডের নির্বাচনকালীন আচরণবিধির আদলে একটি আচরণ বিধি প্রণয়নের চিন্তা-ভাবনা চলছে।