আলমডাঙ্গায় স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক ও পেশাজীবীদের বিশাল বিক্ষোভ মিছিল ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় ঘেরাও
আলমডাঙ্গা ব্যুরো: স্কুলছাত্রী তাহেরা খাতুনকে ক’জন কীভাবে ধর্ষণ শেষে হত্যা করেছে। ধর্ষণের পর লাশের ওপরও কীভাবে পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়েছে তা নিয়ে নানা গুঞ্জন স্থানীয়দের মুখে মুখে। লাশ উদ্ধারের সময় মৃতদেহে দগদগে দাগ দেখার পরও পুলিশ কেন মূল সন্দেহভাজনকে হাতের কাছে পেয়েও ধরলো না? এ প্রশ্ন আলমডাঙ্গার আপামর জনতাকে ক্ষুব্ধ করেছে। সেই ক্ষোভ আলমডাঙ্গায় লাগাতার আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। আন্দোলনের মাঝে কিছু মতলববাজ গতকাল বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর তাণ্ডব চালিয়ে ঘোলাপানিতে মাছ শিকারের অপচেষ্টায় মেতেছে বলে অভিযোগ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের। তারা বলেছে, তাহেরাকে যারা হত্যা করেছে তাদের গ্রেফতারে ব্যর্থতার কারণে ক্ষোভ যখন পুলিশের ওপর, তখন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার হেতু রহস্যজনক। অপরদিকে বাড়িওয়ালার ছেলেসহ তার কয়েক বন্ধুকে ধরতে না পারলেও গৃহশিক্ষক রাশেদকে থানায় নিয়ে পুলিশ দু দিন ধরে জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়ে যাচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে।
গতকাল আলমডাঙ্গায় তাহেরার হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক পেশাজীবীরা বিশাল বিক্ষোভ মিছিল ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেছে। মতলববাজ বেশ কয়েকজন কিশোর শহরের কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর ও একজনের ওপর হামলা চালিয়ে রক্তাক্ত জখম করেছে। এ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় শহরে নিন্দার ঝড় উঠেছে। হামলার ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের দায়িত্ব পালনে অবহেলার অভিযোগ উঠেছে। বিক্ষোভকারীদের একটি অংশ অভিযুক্তের শূন্য বাড়িতেও হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেছে। এতো বড় বিক্ষোভ মিছিলকে কেন্দ্র করে ছিলো না পুলিশের কোনো তৎপরতা।
জানা গেছে, স্কুলছাত্রী তাহেরা হত্যার প্রতিবাদ ও মানুষরূপী হত্যাকারী নরপশুদের গ্রেফতারের দাবি আলমডাঙ্গায় আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। গতকাল রোববার দুপুর ১টায় আলমডাঙ্গায় তাহেরা হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক ও পেশাজীবীরা বিশাল বিক্ষোভ মিছিল ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে। আলমডাঙ্গা পাইলট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, আলমডাঙ্গা পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়, এম সবেদ আলী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, জনকল্যাণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, এরশাদপুর একাডেমী, আলমডাঙ্গা ডিগ্রি কলেজ, আলমডাঙ্গা মহিলা ডিগ্রি কলেজ, হারদী এমএস জোহা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, বেলগাছি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, আলমডাঙ্গা আলিয়া মাদরাসাসহ উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শ শ শিক্ষার্থী, শিক্ষক-অভিভাবক, আলমডাঙ্গা বণিক সমিতি ও বিভিন্ন পেশাজীবীরা ওই কর্মসূচিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। বিক্ষোভ মিছিলটি আলমডাঙ্গা পাইলট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে থেকে শুরু হয়ে উপজেলা পরিষদ চত্বরে গিয়ে অবস্থান করে। বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে অংশ নিতে যাওয়া শিক্ষার্থীদের হাতে বিভিন্ন স্লোগান সংবলিত প্ল্যাকার্ড সমাবেশকে প্রাঞ্জলতা দান করে। ‘স্টপ ভাওলেন্স প্রটেক্ট ওমেন, ‘ধর ধর ধর খুনি ধর। খুনি ধরে জবাই কর, পুলিশ কেন নীরব?, নিজেকে তাহেরার স্থানে বসাও, জাস্টিজ? হোয়ার ইজ দ্য জাস্টিজ?, তাহেরা গেলো এবার কে?, গার্লস হ্যাভ দ্য ইকুয়াল রাইটস টু লিভ ইন দ্য সোসাইটি, স্টুডেন্ট অ্যাকশন ডাইরেক্ট অ্যাকশন, আমার বোন মরলো কেন, দে প্রশাসন জবাব দে’ ইত্যাদি মন্তব্য লিখিত স্লোগানে স্লোগানে সমবেত স্থান শোভিত ছিলো। দীর্ঘসময় উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি চলে। বিক্ষোভকারীরা নরপিশাচ বাচ্চুর কুশপুত্তলিকা দাহ করে। এ সময় আন্দোলনের নেত্বৃত্বদানকারী কাউকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়নি। এ সময় বক্তব্য রাখেন- আলমডাঙ্গা পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক ইলিয়াস হোসেন, এম সবেদ আলী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সিদ্দিকুর রহমান, কলেজ শিক্ষক আমিরুল ইসলাম, যুবলীগ নেতা সাজ্জাদুল ইসলাম স্বপন, এমদাদ হোসেন প্রমুখ। পরে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আশরাফুল আলম সমাবেশস্থলে উপস্থিত হলে তাহেরার খুনিদের গ্রেফতারের নির্ধারিত সময় ঘোষণার দাবি জানানো হয়। এরই প্রেক্ষিতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার সকলের উদ্দেশে বলেন, তাহেরার নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি আপনারা যেভাবে গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন, হত্যাকারীদের বিচারের দাবিকে উচ্চকিত করেছেন, সে জন্য সকলকে ধন্যবাদ জানাই। প্রশাসনের পক্ষে আমরাও বসে নেই। এখনও পোর্স্টমর্টেম রিপোর্ট আসেনি। তারপরও প্রশাসন থেমে নেই। হত্যাকারীদের শনাক্ত করে গ্রেফতার করার অক্লান্ত পরিশ্রম অব্যাহত রয়েছে। এমনকি পুলিশের গোপন শাখাও সবিশেষ তৎপর। তিনি আরো বলেন, জেলা আইনশৃঙ্খলা সভায়ও বিষয়টি গুরুত্বের সাথে আলোচনা করেছি। আমরা আশা করছি খুব শিগগিরই হত্যাকারীদের গ্রেফতার করা সম্ভব হবে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার গ্রেফতারের নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে বিক্ষোভকারীরা ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে। পরে বিক্ষুব্ধদের একাংশ শহরে তাণ্ডব চালায়।
শহরে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা: কতিপয় বিক্ষুব্ধ কিশোর-যুবকরা শহরের হাইরোডে অবস্থিত একটি ট্রাক, আঈন স্পোর্টস অ্যান্ড মোবাইল টাচে ভাঙচুর করে। এছাড়া আওয়ামী লীগ নেতা জহুরুল ইসলাম স্বপনের তানিন বাজারে হামলা চালিয়ে প্লাস্টিকের চেয়ারসহ বেশ কিছু আসবাবপত্র ভাঙচুর করা হয়েছে। এমনকি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাসান কাদির গনুর অফিসের (পুরাতন আওয়ামী লীগ অফিস) চেয়ার ভাঙচুর করেছে। আল আমিন এক্স-রের মালিক আনিস হোসেনের মাথায় আঘাত করে জখম করে। তার মাথায় বেশ কয়েকটা সেলাই দিতে হয়েছে। শহরের চাতাল মোড়ে অবস্থিত মায়ের দোয়া ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেছে। এদিকে বিনা কারণে এ ভাঙচুর ও হামলার ঘটনায় শহরে নিন্দার ঝড় উঠেছে। আঈন স্পোর্টর্সে এবার দিয়ে তিনবার ভাঙচুরের ঘটনা ঘটানো হলো। একটি মতলববাজ গ্রুপ এ ঘটনা বার বার ঘটাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ভাঙচুরের ঘটনায় তানিন বাজারের মালিক স্বপন বাদী হয়ে আলমডাঙ্গা থানায় একটি এজাহার দায়ের করেছেন। এ ভাঙচুর ও হামলার ঘটনায় তাহেরার হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে চলমান আন্দোলনই বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। কাপড়ে মুখ বাঁধা কিছু উচ্ছৃঙ্খলেরা এ অপকর্ম চালিয়েছে বলে অনেকেই দাবি করেছে। আন্দোলনের পুরোধারা কেউই পরিকল্পিতভাবে ও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেননি। যার কারণে সহজেই এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। অনেকের এমনটা মন্তব্য করতে শোনা গেছে। এ উচ্ছৃঙ্খলরা অভিযুক্ত বাচ্চুর জনশূন্য বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেছে।
পুলিশের বিরুদ্ধে দায়িত্বহীনতার অভিযোগ: দু দিন ধরে মাইকিং করে বিক্ষোভ কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছিলো। অথচ এ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পুলিশের কোনো তৎপরতা ছিলো না। অনেকে দাবি করেছেন, পুলিশ বিক্ষোভ মিছিলকে কেন্দ্র করে সক্রিয় ভূমিকা পালন করলে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ভাঙচুর ও হামলার ঘটনা ঘটতো না। শুধুমাত্র এসআই জিয়াউর রহমান ছাড়া পুরো শহরে আর কোনো পুলিশকে দেখা যায়নি। পুলিশের এমন দায়িত্বহীন আচরণে শহরবাসীকে অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। তাহেরার গৃহশিক্ষক রাশেদকে গতপরশু গোয়েন্দা পুলিশ ও আলমডাঙ্গা থানা পুলিশ শহরের মাদরাসাপাড়ার ভাড়াবাসা থেকে আটক করে চুয়াডাঙ্গায় নেয়। দিনভর চলে জিজ্ঞাসাবাদ। গতকাল রাতে এ সংবাদ লেখা পর্যন্ত তাকে পুলিশ ছাড়েনি বলে জানা গেছে।
অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা সত্ত্বেও তাহেরার হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে চলমান এ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় আলমডাঙ্গার বিভিন্ন স্তরের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের নিকট থেকে উচ্চারিত হচ্ছে। ভাঙচুরের কারণে রাতেই আন্দোলনের কমিটির পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করে শহরে মাইকিং করা হয়েছে।