বাংলাদেশে দুর্নীতিতে বিশ্বে ১৪তম : দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয়

স্টাফ রিপোর্টার: বিশ্বের মোট ১৭৫টি দেশের দুর্নীতি প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ১৪তম, গত বছর এ অবস্থান ছিলো ১৬তম। আর দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তানের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। গতকাল বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এ তথ্য প্রকাশ করে।

টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়, মোট ১০০ স্কোরের মধ্যে বর্তমানে বাংলাদেশের স্কোর ২৫। তবে বাংলাদেশের সাথে যৌথভাবে ২৫ স্কোর পেয়েছে গিনি, লাওস, কেনিয়া ও পাপুয়া নিউগিনি। গত বছর বাংলাদেশের স্কোর ছিলো ২৭ পয়েন্ট। এ তালিকায় মাত্র আট স্কোর করে শীর্ষে রয়েছে সোমালিয়া ও উত্তর কোরিয়া। এছাড়া ১১ ও ১২ স্কোর পেয়ে তালিকার সর্বনিম্নের দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয়েছে সুদান ও আফগানিস্তান। পরবর্তী দেশগুলো পর্যায়ক্রমে- দক্ষিণ সুদান, ইরাক, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, লিবিয়া, ইরিত্রিয়া, ইয়েমেন, ভেনেজুয়েলা, হাইতি, গিনি, অ্যাঙ্গোলা, সিরিয়া, বরুন্ডি, জিম্বাবুয়ে, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, চাঁদ, তাজিকিস্তান, কঙ্গো, প্যারাগুয়ে, পাপুয়া নিউগিনি, লাওস, কেনিয়া, গিনি, বাংলাদেশ। অন্যদিকে কম দুর্নীতিগ্রস্ত তালিকার শীর্ষে রয়েছে ডেনমার্ক। ডেনমার্কের স্কোর ৯২। এছাড়া ৯১ পয়েন্ট পেয়ে দ্বিতীয় নিউজিল্যান্ড, তৃতীয়, ফিনল্যান্ড।

সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান জানান, এ বছর বাংলাদেশ ০-১০০ স্কেলে ২৫ স্কোর পেয়ে ১৭৫টি দেশের মধ্যে ঊর্ধ্বক্রম অনুসারে ১৪৫তম এবং নিম্নক্রম অনুসারে ১৪তম অবস্থানে রয়েছে। ২০১৩ সালের তুলনায় অবস্থানের নিম্নক্রম অনুযায়ী দু ধাপ নিচে নেমেছে এবং গত বছরের ২৭ স্কোরের চেয়ে দু স্কোর কম পেয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া উচ্চক্রম অনুযায়ী গত বছরের তুলনায় বাংলাদেশ এ বছর নয় ধাপ নিচে নেমে গেছে। তিনি বলেন, একমাত্র আফগানিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার ৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ নিম্নক্রম অনুযায়ী দ্বিতীয় সর্বনিম্নে অবস্থান করছে এবং ২০১৪ সালে বাংলাদেশ দু পয়েন্ট কম পাওয়ায় এবং তা বৈশ্বিক গড় ৪৩ এর চেয়ে অনেক কম হওয়ায় সার্বিকভাবে দুর্নীতির বৈশ্বিক ধারণা সূচকে বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রকট আকার ধারণ করেছে।

তিনি আরো বলেন, ২০১৪ সালের সিপিআই অনুযায়ী ৯২টি দেশের স্কোর বৃদ্ধি পেয়েছে, ৪৭টি দেশ পূর্বের স্কোর ধরে রেখেছে। অন্যদিকে যে ৩৬টি দেশের স্কোরের অবনতি হয়েছে, দুঃখজনকভাবে সেই তালিকায় বাংলাদেশও রয়েছে। ড. ইফতেখারুজ্জামান অভিমত প্রকাশ করে বলেন, বিভিন্ন কারণে সিপিআই সূচকে এ বছর ক্রমাবনতি হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দুর্নীতিবিরোধী অঙ্গীকার অনুযায়ী যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের ঘাটতি, কার্যকরভাবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের দৃষ্টান্তের অভাব, দুদকের স্বাধীনতা খর্ব করার অপপ্রয়াস, পদ্মা সেতু প্রকল্প, রেলওয়ে নিয়োগ বাণিজ্য, শেয়ারবাজার, হলমার্ক ও ডেসটিনি এবং সোনালী ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে ব্যাপক অনিয়ম, রানা প্লাজার ঘটনার ব্যাপারে শৈথিল্য, ক্ষমতাবানদের বৈধ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন সম্পদের বৃদ্ধি, খেলাপি ঋণের দৌরাত্ম্য, সংসদসহ সংশ্লিষ্ট জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা, নিয়োগ বাণিজ্যের রাজনীতিকীকরণ এবং ভূমি ও নদী-জলাশয় দখলের মহোৎসব। তিনি আরো বলেন, বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগকে কেন্দ্র করে দুদককে অনেক সময়ই দেখা গেছে সরকারের এক প্রকার বি-টিমের ভূমিকা পালন করতে।

এ প্রসঙ্গে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সিপিআই সম্পর্কে যথাযথ ধারণার অভাবে মনে করা হয় বাংলাদেশ বা তার অধিবাসী দুর্নীতিগ্রস্ত। বাস্তবে দেশের আপামর জনগণ দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। তারা দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভুক্তভোগী মাত্র। ক্ষমতাবানদের দুর্নীতি ও তা প্রতিরোধে দেশের নেতৃত্ব ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যর্থতার কারণে দেশ বা জনগণকে কোনোভাবেই দুর্নীতিগ্রস্ত বলা যাবে না।

সংবাদ সম্মেলনে সুলতানা কামাল বলেন, দুর্নীতি ও অনিয়মের ব্যাপক বিস্তার ও জবাবদিহিতার ঘাটতির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের দরিদ্র জনগণ। তবে সরকারের পক্ষ থেকে দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর ও দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ আমরা দেখতে পাইনি। সে কারণে রাজনৈতিক অঙ্গীকার অনুযায়ী কার্যকরভাবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার দায় সরকারকেই নিতে হবে। তিনি আরো বলেন, যে কোনো সচেতন ও দায়িত্বশীল নাগরিকের কর্তব্য হচ্ছে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সক্রিয় হয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধের দাবিতে সোচ্চার হওয়া। তাছাড়া দুর্নীতি দূর করতে হলে সরকারের পাশাপাশি গণমাধ্যম, সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।

টিআইবির ট্রাস্টিবোর্ডের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে আরো ছিলেন সদস্য এম হাফিজউদ্দিন খান, ড. এটিএম শামসুল হুদা এবং উপ-নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের। সিপিআই ২০১৪-এর জন্য বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সূত্র হিসেবে

৭টি প্রতিষ্ঠানের তথ্য যথাক্রমে: বার্টেলসমান ফাউন্ডেশন পরিচালিত ট্রান্সফরমেশন ইনডেক্স, ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট পরিচালিত কান্ট্রি রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট, গ্লোবাল ইনসাইটের কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস, পলিটিক্যাল রিস্ক সার্ভিসেসের ইন্টারন্যাশনাল কান্ট্রি রিস্ক গাইড, বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি পলিসি অ্যান্ড ইন্সটিটিউশনাল অ্যাসেসমেন্ট, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক্সিকিউটিভ ওপিনিয়ন সার্ভে এবং ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট পরিচালিত রুল অব ল’ ইনডেক্সের রিপোর্টসমূহের জরিপ ব্যবহৃত হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সিপিআই নির্ণয়ে টিআইবি কোনো ভূমিকা পালন করে না। এমনকি টিআইবির গবেষণা থেকে প্রাপ্ত কোনো তথ্য বা বিশ্লেষণ সিপিআইয়ে পাঠানো হয় না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের টিআই চ্যাপ্টারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। অন্যান্য দেশের টিআই চ্যাপ্টারের মতোই টিআইবি দুর্নীতির ধারণাসূচক স্থানীয় পর্যায়ে প্রকাশ করে মাত্র।

Leave a comment