লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতার না করার ইস্যুতে অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা

স্টাফ রিপোর্টার: আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সাবেক সদস্য আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে দেশে নতুন করে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অধিকাংশ দলই আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর গ্রেফতার দাবি করেছে। তাকে গ্রেফতারে হেফাজতে ইসলামের হরতাল কর্মসূচিসহ ২০ দলীয় জোটের বাইরে থাকা ইসলামী দলগুলোও বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। জাতীয় সংসদের ভেতরে-বাইরে তার গ্রেফতারের দাবি উঠেছে।

IAB-DC-01

সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর গ্রেফতার নিয়ে তৈরি হয়েছে ধূম্রজাল। গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকা সত্ত্বেও রোববার রাতে এয়ারপোর্ট দিয়ে নির্বিঘ্নে তার দেশে ফেরা এবং সোমবার রাত ১০টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আটক করতে না পারায় জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্নের। এমনকি তার গ্রেফতারের দাবিতে সোমবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিলো রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। বাদ ছিলো না সংসদ অধিবেশনও। কিন্তু এরপরও দিনভর নির্বিকার ছিলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সরকারের ওপর মহলের সবুজ সঙ্কেত না পাওয়া পর্যন্ত আপাতত তিনি অধরাই থাকবেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন সরকার সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র।

লফিত সিদ্দিকীর গ্রেফতারের ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী নানা জটিলতার দাবি করলেও স্পিকার তা নাকচ করে দিয়েছেন। অবশ্য সোমবার সরকারের কয়েকজন নীতিনির্ধারকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, বিষয়টি (লতিফ সিদ্দিকীর দেশে ফেরা) সম্পর্কে তারা কিছু জানেন না। সরাসরি কোনো মন্তব্য করতেও অস্বীকৃতি জানান সরকারি দলের নেতারা। এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ মহলের সিদ্ধান্তের প্রতি ইঙ্গিত করেন তারা। স্পর্শকাতর এ ইস্যুটি বর্তমানে সারা দেশের মানুষের কাছে প্রধান আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হলেও সোমবার অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ নিয়ে কোনো কথাই হয়নি।

লতিফ সিদ্দিকী নির্বিঘ্নে দেশে ফেরার পর সোমবার আগাম জামিনের জন্য গোপনে আদালতে যান বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। তবে গণমাধ্যম কর্মীরা তার হদিস পাননি। ছিলেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। তিনি এখন কোথায় আছেন? কি করছেন? তা জানা না গেলেও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করে বলছেন, সাবেক এ মন্ত্রী তাদের নজরদারিতেই রয়েছেন। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশ পেলে তারা তাকে গ্রেফতার করতে পারবেন। রাতে পতিত এ মন্ত্রীর গ্রেফতারের দাবিতে সংসদ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা অবিলম্বে তার গ্রেফতার দাবি করেন।
মন্ত্রিত্ব হারানো ও আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত এ সংসদ সদস্য রোববার রাতে দেশে ফিরলেও পুরো নভেম্বর মাস জুড়েই তিনি চেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন বলে একটি সূত্র দাবি করেছে। সাবেক এ মন্ত্রী দেশে ফেরার আগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দিল্লি যান। সেখানে ক্ষমতাসীন বিজেপি ছাড়াও কংগ্রেস নেতাদের সাথে তার বৈঠক হয়। লতিফ সিদ্দিকীর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, কংগ্রেস নেতাদের সহযোগিতায় এত দিন তিনি কলকাতায় অবস্থান করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় থেকেই এই কংগ্রেস নেতাদের সাথে সিদ্দিকী পরিবারের ঘনিষ্ঠতা। এ নেতাদের মধ্যে অনেকেই খুবই প্রভাবশালী। যারা কংগ্রেসের ওপর মহলকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন।

আগাম জামিনের জন্য সোমবার হাইকোর্টে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লেও গণমাধ্যম কর্মীদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে ছিলেন লতিফ সিদ্দিকী। এক পর্যায়ে খবর ছড়িয়ে পড়ে বিকালে সংসদ অধিবেশনে যোগ দেবেন মন্ত্রিত্ব হারানো ও আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত এই সংসদ সদস্য। তবে শেষ পর্যন্ত আবদুল লতিফ সিদ্দিকী সংসদে যাননি। লতিফ সিদ্দিকী সংসদ অধিবেশনে যোগ দেয়ার ব্যাপারে কিছু জানিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, লতিফ সিদ্দিকী তার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। এ সময় সংসদ সদস্যদের গ্রেফতারের ব্যাপারে আইনি ব্যাখ্যা দেন স্পিকার।

শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, সংসদ সদস্য পদ থাকায় আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে সংসদ চত্বরের বাইরে থেকে গ্রেফতারে স্পিকারের অনুমতির প্রয়োজন নেই। তবে দ্যা ইস্ট পাকিস্তান অ্যাসেম্বলি মেম্বারস প্রিভিলেজেস অ্যাক্ট-১৯৬৫ এ বলা হয়েছে, সংসদ অধিবেশন চলার সময় এবং অধিবেশন শুরুর ৭ দিন আগে ও শেষের ৭ দিন পরে কোনো সংসদ সদস্যের দেওয়ানি, ফৌজদারি এবং রাজস্ব আদালতে স্বশরীরে হাজির হওয়ার ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা নেই।

লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতারের ক্ষেত্রে আইনি জটিলতার কথা বলেছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও। গ্রেফতারি পরোয়ানার আসামি লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতারে পুলিশ ব্যর্থ হয়েছে কি-না? গতকাল সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এই প্রশ্নে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমাদের কোনো ব্যর্থতা নেই। গ্রেফতারে আদালতের নির্দেশনা রয়েছে সত্য, তেমনি তিনি এখনও সংসদ সদস্য, এটাও সত্য। তিনি আরও বলেন, তাকে (লতিফ) গ্রেফতারের ক্ষেত্রে আইনি জটিলতা আছে। এর বেশি কিছু আমি জানি না।

প্রতিমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে সর্বত্রই প্রশ্ন উঠেছে সরকারের সবুজ সঙ্কেত পেয়েই কি লতিফ সিদ্দিকী দেশে ফিরলেন? কারণ বিমানবন্দরে কড়া নিরাপত্তা ভেদ করে একজন গ্রেফতারি পরোয়ানার আসামি বেরিয়ে যাওয়াটা দুঃসাধ্য। আর লতিফ সিদ্দিকী বিমানবন্দরে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার নজরদারিতেই ছিলেন বলে জানা গেছে। এদিকে সোমবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত লতিফ সিদ্দিকীর দেশে ফেরার ব্যাপারে বলেন, তিনি কোনো অনাকাক্সিক্ষত ব্যক্তি নন।

সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে এক সভায় হজ নিয়ে বক্তব্যের জেরে মন্ত্রিত্ব ও আওয়ামী লীগের সদস্য পদ হারান লতিফ সিদ্দিকী। ধর্ম অবমাননার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন আদালতে কয়েক ডজন মামলা হয়। এর মধ্যে ২২টিতে গ্রেফতারি পরোয়ানাও রয়েছে। তার মধ্যেই রোববার রাতে দেশে ফেরেন তিনি।

বিভিন্ন স্থানে গ্রেফতার দাবিতে মিছিল সমাবেশ: আবদুল লতিফ সিদ্দিকী আগাম জামিনের জন্য হাইকোর্টে হাজির হয়েছেন- সোমবার সকালে এমন সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। তার উপস্থিতি নিয়ে দিনভর গুঞ্জন চলে হাইকোর্ট চত্বরে। হাইকোর্টে উপস্থিতির সংবাদে আদালতের বিভিন্ন বেঞ্চ ও বারান্দায় তীক্ষ্ণ নজর রাখেন গণমাধ্যমকর্মী ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। কিন্তু কেউ তার দেখা পাননি।
সরকারদলীয় সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম সুজন লতিফ সিদ্দিকীর পক্ষে জামিনের আবেদন করছেন বলে সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। তার বরাত দিয়ে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে এ বিষয়ে ব্রেকিং নিউজ প্রচার হতে থাকে। এরপর এ খবরের সত্যতা জানতে সাংবাদিকরা ছুটে যান সুজনের কাছে। কিন্তু তিনি লতিফ সিদ্দিকীর পক্ষে মামলা করছেন না বলে জানান। এমনকি সকালে তার বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যম যে সংবাদ প্রচার করেছে তাও অস্বীকার করেন সুজন।

নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, লতিফ সিদ্দিকী নামে কোনো মক্কেল আমার সাথে যোগাযোগ করেননি। তিনি হাইকোর্টে এসেছেন এমন কথাও আমি কাউকে বলিনি। লতিফ সিদ্দিকী জামিন নিতে হাইকোর্টে এসেছেন কি-না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সোমবার বিকালে বলেন, এমন কোনো সংবাদ আমার কাছে নেই। তিনি জামিনের আবেদন করেছেন কিনা প্রশ্নের জবাবেও তিনি একই উত্তর দেন।

এদিকে লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতারের দাবিতে বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা সোমবার দুপুরে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনে বিক্ষোভ মিছিল করেন। অ্যাডভোকেট গাজী কামরুল ইসলাম সজল, শরীফ ইউ আহমেদ, মির্জা আল মাহমুদ প্রমুখ আইনজীবী মিছিলে ছিলেন। এ সময় লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে নানা ধরনের স্লোগান দেয়া হয়।

গ্রেফতারের দাবিতে রিট: ১০ নভেম্বর লতিফ সিদ্দিকীকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের দাবিতে হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়। বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি আশরাফুল কামালের বেঞ্চ তখন এ রিট আবেদনটির শুনানি মুলতবি রাখেন। সোমবার একই বেঞ্চে একটি সম্পূরক আবেদন দাখিল করেন রিটকারী আইনজীবী ইউনুস আলী আকন্দ। আকন্দ জানান, সোমবার দুপুরে আবেদনটি শুনানির জন্য একই বেঞ্চে নেয়া হয়। আদালত আবেদনটি রেকর্ডে রেখেছেন এবং ধৈর্য ধরতে বলেছেন। আদালত বলেছেন, আগে দেখেন সরকার কী করে।

লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে আন্দোলন- কলাপাড়ায় চরমোনাই পীর: চরমোনাই পীর ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেছেন, লতিফ সিদ্দিকী শান্ত বাংলাদেশকে অশান্ত করতে ফের বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। প্রশ্ন উত্থাপন করে তিনি বলেন, কাদের মদদে লতিফ বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন? সরকারকে হুঁশিয়ার করে চরমোনাই পীর বলেন, লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে বাংলাদেশের মুসলমান এর বিরুদ্ধে রাজপথে নামবে। ইসলামী আন্দোলন কলাপাড়া উপজেলা শাখার সভাপতি আলহাজ হযরত মাওলানা মুফতি হাবিবুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে আরও বক্তৃতা করেন মুফতি হেদায়েত উল্লাহ জিহাদি, মাওলানা আরআইএম ওয়াহিদুজ্জামান, তোফাজ্জেল হোসেন, মাওলানা আসাদুজ্জামান ইউসুফ, মাহবুবুর রহমান প্রমুখ।