এক অসহায় নারীর আকুতি : আমি বাঁচতে চাই

ক্ষুধার জ্বালায় হাঁস-মুরগির জন্য ফেলে দেয়া ভাত কুড়িয়ে খেয়েছি

 

বখতিয়ার হোসেন বকুল: ক্ষুধার জ্বালায় রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে প্রতিবেশীদের রান্না ঘরের পাশে ঘুরে ঘুরে ভাতের মাড় আর হাঁস-মুরগির জন্য ফেলে দেয়া ভাত কুড়িয়ে খেয়েছি। একমাত্র অবলম্বন পেটের সন্তানটিও নষ্ট করে দেয় শাশুড়ি আশুরা বেগম। এটা কোনো কল্পকাহিনী, গল্প বা উপন্যাসের কথা বলছি না। এ সত্য কাহিনি তুলে ধরেছেন সব হারানো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক অসহায় নারী চন্দনা। যার বর্তমান নাম তানিয়া (ধর্ম ত্যাগের পর নতুন নাম)। তিনি এ কাহিনি বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং বলেন ইতঃপূর্বে আমি বিচারের আশায় যাদের কাছেই গিয়েছি তারাই আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ক্ষুধার্ত হায়নার মতো আমাকে খাবলে খেয়েছে। উপকার তো করিইনি বরং উল্টে চেয়েছে টাকা। তিনি মানবাধিকার সংগঠনের সহায়তা কামনা করে বলেছেন, আপনারা আমাকে বাঁচান। আমি বাঁচতে চাই। বিচার চাই প্রতারক ওই শ্বশুর-শাশুড়ির।

জানা গেছে, খুলনা জেলার রূপসা থানার দেবীপুর গ্রামের স্টেশন মাস্টার দীপক কুমার সাহার একমাত্র মেয়ে চন্দনা রাণী সাহার সাথে একই গ্রামের স্বপন কুমার সাহার ছেলে গৌরকুমার সাহার প্রায় ৭ বছর আগে বিয়ে হয়। বিয়ের বছর পার হতে না হতেই স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে স্বামী মারা যায়। ইতি হয় সংসার জীবনের। এর কিছুদনি পর মেয়ে চন্দনাকে পিতা পাঠিয়ে দেন বিদেশে। চন্দনা ২০০৯ সালে পাড়ি জমায় মধ্যপ্রাচের দেশ জর্ডানে। সেখানে ৩ বছর থাকার পর ৩ মাসের ছুটি নিয়ে দেশে ফিরে আসেন চন্দনা। ছুটির দু মাস পর পুনরায় বিদেশ যাওয়ার জন্য টিকেট কনফার্ম করতে ট্রেনযোগে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন চন্দনা। খুলনা থেকে ট্রেনযোগে আসার সময় যশোর স্টেশন থেকে ওই ট্রেনেই ওঠেন দামুড়হুদা উপজেলার পাটাচোরা গ্রামের মৃত আকবার মল্লিকের ছেলে রফিক (৫৫) ও একই গ্রামের মৃত আব্দার মল্লিকের ছেলে আকরাম ( ৫৪)। চন্দনার সাথে তাদের পরিচয় হয় ট্রেনের মধ্যে। শুরু হয় তাদের মধ্যে আলাপচারিতা। আলাপচারিতার একপর্যায়ে প্রতারক রফিক চন্দনাকে মেয়ে বলে সম্বোধন করেন এবং চেয়ে নেন মোবাইল নম্বর। চন্দনা চলে যান ঢাকায় আর রফিক ও আকরাম ফিরে আসেন নিজ গ্রাম পাটাচোরায়। ওই রাতেই রফিক ফোন দেন চন্দনার কাছে। তার শারীরিক অবস্থার খোঁজখবরও নেন। চন্দনা তিন দিন ঢাকায় থেকে টিকেট কনফার্ম করে বাড়ি ফেরার দিন রফিক ও তার স্ত্রী আশুরা বেগম তাকে পাটাচোরা হয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানান। অনুরোধ ফেলতে না পেরে সরল মনে সম্মতি দেয়। জেনে নেন পাটাচোরা আসার ঠিকানা। ঢাকার একটি পরিবহনযোগে ভোরে কার্পাসডাঙ্গা পৌছান চন্দনা। রফিক তাকে কার্পাসডাঙ্গা থেকে নিয়ে যায় পাটাচোরার নিজ বাড়িতে। শুরু হয় আদর আপ্যায়ন। রফিক ও তার স্ত্রী বলেন, মা তুমি আজ থেকে আমার মেয়ে। তোমার কাছে টাকা-পয়সা, সোনার গয়না রয়েছে। এলাকার লোকজন ভালো না। বাইরে কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। দু দিন থাকার পর চন্দনা বাড়ি যেতে চাইলে বলে মা তুমি আর কটা দিন থেকে যাও। চন্দনাও অন্ধ হয়ে যায় নতুন মা-বাবার ভালোবাসায়। চন্দনা তখনও বুঝতে পারেনি তাদের চাতুরতা। অচেনা একটি হিন্দু সম্প্রদায়ের মেয়ে রফিকের বাড়িতে আছে বিষয়টি জানাজানি হয়ে পড়লে গ্রামবাসীর চাপে রফিক তার ছেলে রাজমিস্ত্রি বেল্টুর সাথে বিয়ে দেন চন্দনার। গাইদঘাটের এক কাজির কাছে দু লাখ ৭৫ হাজার টাকা দেনমোহর ধার্য করে বিয়ে হয় তাদের। চন্দনার নাম পাল্টে রাখা হয় তানিয়া।

এদিকে মেয়ে ঢাকায় গিয়ে ফিরছে না ভেবে চন্দনার পরিবারের লোকজন দিশেহারা হয়ে পড়ে। চন্দনার মা রিতা রায় ফোন দেয় মেয়ের কাছে। ওই রফিক ফোন ধরে চন্দনার মার কাছে বলে আপনার মেয়ে ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়েছে এবং আমার ছেলের সাথে তার বিয়ে দিয়েছি। আপনি আর ফোন দেবেন না বলে চন্দনার ব্যবহৃত মোবাইলফোন ভেঙে ফেলেন প্রতারক রফিক। চন্দনা আরো জানান, আমার ধর্মত্যাগ ও বিয়ের বিষয়টি শুনে আমার মা স্ট্রোক হয় এবং পরদিন মারা যান। আমি আমার মায়ের মরা মুখটিও দেখতে পারেনি। বিয়ের পর আমার শ্বশুর নতুন বিল্ডিং তৈরি করে দেয়ার জন্য টাকার কথা বললে আমি শ্বশুরকে সাথে করে খুলনা রূপালী ব্যাংক কাঁচদিয়া শাখা থেকে কয়েক দফায় প্রায় দু লক্ষাধিক টাকা তুলে দিই। আমার কাছে থাকা দেড় ভরি সোনার গয়না ও দুটি সোনার বিস্কুট ছিলো তাও তুলে দিই শ্বশুরের হাতে। সর্বশেষ বিকাশের মাধ্যমে আরো দু লাখ টাকা তুলে দিই শ্বশুরের হাতে। সংসারের সুখের কথা ভেবে আমার কাছে টাকা পয়সা সোনা-দানা যা ছিলো সবই তুলে দিই শ্বশুরের হাতে। এটি প্রায় বছর দেড়েক আগের কথা। এরপর শুরু হয় আমার ওপর নির্যাতন। এরই এক ফাঁকে আমার স্বামী বেল্টু ঢাকায় যাওয়ার নাম করে বাড়ি বের হয়ে আর ফেরেনি। বেশ কিছুদিন পর আমি জানতে পারি সে বিদেশ চলে গেছে। বর্তমানে সে ইরাকে আছে। স্বামী বিদেশ চলে যাওয়ার পর শ্বশুর ও শাশুড়ি মিলে আমার ওপর বাড়িয়ে দেন নির্যাতনের মাত্রা। দিনের পর দিন ঘরে আটকে রাখতো আমাকে। খেতেও দিতো না ঠিকমতো। একমাত্র অবলম্বন দেড়মাস বয়সী পেটের সন্তানটিও ওষুধ খাইয়ে নষ্ট করে দেয় শাশুড়ি আশুরা বেগম।

ক্ষুধার জ্বালায় রাতে টয়লেটে যাওয়ার অজুহাতে লুকিয়ে লুকিয়ে বাইরে রেবিয়ে প্রতিবেশীদের রান্নাঘরের পাশে ঘুরে ঘুরে ভাতের মাড় আর হাঁস-মুরগির জন্য ফেলে দেয়া ভাত কুড়িয়ে খেয়ে বেঁচে ছিলাম প্রায় ১৮/২০ দিন। শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে একদিন আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আমার শ্বশুর আমাকে ডাক্তার দেখানোর নাম করে বাড়ি থেকে নিয়ে আসে রঘুনাথপুর ঘাটে। ওখান থেকে একটি করিমনে তুলে দেয়। তিনি আর আসেননি। করিমনচালক আমাকে দামুড়হুদা বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে দেন। অসুস্থ শরীরে সারাদিন বাস্ট্যান্ডে বসে থাকি। এরই একপর্যায়ে বিকেলে জ্ঞান হারিয়ে ফেললে বাসস্ট্যান্ডের হোটেলব্যবসায়ী আনছার আলী আমাকে মুমূর্ষু অবস্থায় চিৎলা হাসপাতালে নিয়ে আসেন। ৭ দিন চিকিৎসা শেষে একটু সুস্থ হওয়ার পর আবারও ফিরে যাই পাটাচোরায়। কিন্তু আমার শ্বশুর-শাশুড়ি আমাকে বাড়িতে ঢুকতে না দিলে আবারও ফিরে আসি দামুড়হুদায়। এক ভদ্রলোক আমাকে দর্শনা মৌচাক নামক একটি এনজিও’র ঠিকানা দেয়। আমি ছুটে যাই ওই মৌচাক নামক এনজিও প্রতিষ্ঠানে। ওখানে ৫ মাস রান্নার কাজ করি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমি এলাকার বহু মানুষের কাছে এসেছি। চেয়েছি বিচার আর স্বামীর বাড়িতে একটু আশ্রয়। ইতঃপূর্বে আমি বিচারের আশায় যাদের কাছেই গেছি তারা সকলেই আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ক্ষুধার্ত হায়নার মতো আমাকে খাবলে খেয়েছে। বলেছে টাকা না দিলে কেস হয় না। অসহায় চন্দনার বর্তমানে ঠাঁই মিলেছে উপজেলার সুবলপুর গ্রামের ব্রিজপাড়ার ওসমান আলী ওরফে পান ওসমানের বাড়িতে।

অসুস্থ চন্দনা মানবাধিকার সংগঠনের সহযোগিতা কামনা করে বলেন, পিতা-মাতা, টাকা-পয়সা স্বমী সংসার সব হারিয়ে আমি আজ নিঃস্ব। আমি আর পারছি না। আপনারা আমাকে বাঁচান। আমি বাঁচতে চাই। বিচার চাই প্রতারক ওই শ্বশুর-শাশুড়ির আর যারা আমার শরীরকে খাবলে খেয়েছে তাদের।