স্টাফ রিপোর্টার: মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে ছাত্রছাত্রী ভর্তির ক্ষেত্রে তুলনামূলক কঠিন শর্তারোপ করা হচ্ছে। গত কিছুদিন ধরে শোনা যাচ্ছিলো, লিখিত পরীক্ষায় ন্যূনতম পাস নম্বর বেঁধে দেয়া হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত সর্বশেষ খবর হচ্ছে, বাস্তবতা বিচারে শেষ পর্যন্ত পাস নম্বর নির্ধারণ করা হয়নি। পর্যায়ক্রমে পাস নম্বর ৪০ নির্ধারণের পথে এগোবে মন্ত্রণালয়।
সূত্রগুলো বলছে, বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজগুলোতে যাচ্ছেতাই মানের শিক্ষার্থী ভর্তি নিয়ন্ত্রণে ধারাবাহিকভাবে পদক্ষেপ আসবে। এ বছর থেকে নতুন আরোপিত শর্ত হিসেবে, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় প্রাপ্ত জিপিএ এবং লিখিত পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর মিলে অর্জিত স্কোর কমপক্ষে ১২০ হতে হবে। অন্যথায় কোনো শিক্ষার্থী এমবিবিএস ও বিডিএস কোর্সে ভর্তির যোগ্য হবেন না। গত বছর সব মিলে ১১০ স্কোরধারী বেশকিছু শিক্ষার্থী বেসরকারি মেডিকেলে ভর্তি হয়েছিলেন। এ নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। কেউ কেউ এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার উভয়টিতে জিপিএ-৫ পেয়ে ১০০ স্কোর নিয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়। ভর্তি পরীক্ষায় তারা পেয়েছিলেন মাত্র ১০। বেসরকারি কলেজগুলোতে আসন সংখ্যা খালি পড়ে থাকার সুযোগে তারাও চিকিৎসক হওয়ার সুযোগ পেয়ে গিয়েছেন।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এমবিবিএস এবং বিডিএস কোর্সে সর্বোচ্চ মানের শিক্ষার্থীরা ভর্তির সুযোগ পায়। এমনি একটি সাধারণ ধারণা দেশে প্রচলিত আছে। সরকারি-বেসরকারি সূত্র বলছে, প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় মানের সাথে আপস করতে হচ্ছিলো। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ সুযোগ সংকুচিত করতে চায়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (চিকিৎসা শিক্ষা) মো. আইয়ুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, চিকিৎসা শিক্ষা খাতকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে পর্যায়ক্রমে আরও কিছু পদক্ষেপ আসবে। প্রথম ধাপ হিসেবে সম্মিলিত মেধাস্কোর কমপক্ষে ১২০ নির্ধারণ করা হলো। বিষয়টির ব্যাখ্যা করে আইয়ুবুর রহমান জানান, দুটি পাবলিক পরীক্ষার জিপিএ অনুযায়ী যার স্কোর ৮০, তাকে ভর্তি হতে হলে লিখিত পরীক্ষায় ৪০ পেতে হবে। যার উভয়টি জিপিএ-৫, অর্থাৎ ১০০ স্কোর রয়েছে, তাকে কমপক্ষে ২০ পেতে হবে। এভাবে পদ্ধতিটি এবারের পরীক্ষা থেকে কার্যকর করা হচ্ছে। চিকিৎসা শিক্ষা নিয়ে ভাবেন এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে কাউকে চিকিৎসক হওয়ার সুযোগ দেয়া উচিত নয়। কারণ এর সাথে মানুষের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবার বিষয়টি জড়িত। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছেতাই মানের শিক্ষার্থী ভর্তি করালে ভবিষ্যতে অযোগ্য ও অদক্ষ চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়বে। এতে চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা বা ভুল চিকিৎসায় জনস্বাস্থ্য বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা। উদাহরণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সাধারণ শিক্ষায় উচ্চতর ডিগ্রিলাভ করলে তার দ্বারা মানুষ মেরে ফেলার মতো ঘটনার আশঙ্কা থাকে না বললেই চলে। কিন্তু চিকিৎসার বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। এর সাথে মানুষের জীবন ও সুস্থতা জড়িত। সূত্রগুলো বলছে, মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি পদ্ধতি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ১০ এপ্রিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে শুধু জিপিএ ভিত্তিতে শিক্ষার্থী ভর্তি না করিয়ে লিখিত পরীক্ষা পদ্ধতি বহাল রাখার পক্ষে অভিমত তুলে ধরেন বিশেষজ্ঞরা। ওই বৈঠকে ভর্তি পরীক্ষায় মাত্র ১০ পেয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করানোর কড়া সমালোচনা করেন চিকিৎসা, শিক্ষা ও গবেষণায় দেশের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. প্রাণগোপাল দত্ত এবং সাবেক বিএমএ সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব। বৈঠকে উপাচার্য ডা. প্রাণগোপাল দত্ত বলেন, ভর্তি পরীক্ষায় মাত্র ১০ পেলে ওই শিক্ষার্থী নিশ্চিতভাবেই অকৃতকার্য হয়েছেন। তাকে চিকিৎসা শিক্ষায় ভর্তি করানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই, থাকতে পারে না। কিন্তু মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের নীতিমালার ফাঁকফোকর দিয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। ডা. রশিদ-ই-মাহবুব ওই বৈঠকে বলেন, কাদের চিকিৎসক বানানো হবে সেটা নিয়ে আরও গভীর চিন্তার অবকাশ আছে। চিকিৎসা সেবা অযোগ্যদের হাতে ছেড়ে দেয়া যাবে না।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সরকারি-বেসরকারি সব মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তির লক্ষ্যে একযোগে পরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বটি স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাতে ন্যস্ত। মন্ত্রণালয় নীতিমালা তৈরি করে দিচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে কেন্দ্রীয়ভাবে ভর্তি পরীক্ষা পরিচালনায় অধিদফতর দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, সরকারি মেডিকেলে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের মান নিয়ে প্রশ্ন নেই। গত বছর সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীর সর্বনিম্ন স্কোর ছিলো ৬১ দশমিক ২৫। কিন্তু বিপত্তি বাধে বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের ক্ষেত্রে। অর্ধ শতাধিক বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অনেকগুলোতে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে, এমনকি কেবলমাত্র আসন সংখ্যা পূর্ণ করার অজুহাতে কম স্কোরধারী শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. খন্দকার ডা. সিফায়েত উল্লাহ বলেন, চিকিৎসা খাতে জনবলের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। এ জন্য বেসরকারি খাতে কলেজ অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রণালয়। কিন্তু তার মানে এই নয়, যাকে তাকে চিকিৎসক বানিয়ে দিতে হবে। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদেরও উচ্চতর দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে এমবিবিএস ও বিডিএস কোর্সে ভর্তির সুযোগ করে নিতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চিকিৎসা শিক্ষা শাখা থেকে জানা যায়, এ বছর দেশের ২২টি সরকারি মেডিকেলে মোট ২ হাজার ৮১২টি আসন রয়েছে। বেসরকারি খাতে অনুমোদিত মেডিকেলের সংখ্যা ৫৪টি। সেখানে আসন সংখ্যা ৪ হাজার ৮০০।
অন্যদিকে সরকারি খাতে একটি ডেন্টাল কলেজ ও ৮টি ডেন্টাল ইউনিট মিলে ভর্তি করা হবে ৫৩২ জন শিক্ষার্থী। বেসরকারি ১৮টি ডেন্টাল কলেজে নেয়া হবে ১ হাজার ৫০ জন শিক্ষার্থী।
সূত্রগুলো বলছে, বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজগুলোতে ভর্তি ফি বাবদ গলাকাটা ফি নেয়া হচ্ছে। এসব কলেজে শিক্ষার্থীপ্রতি এককালীন ১২ লাখ টাকা থেকে এমনকি ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়ে ভর্তি করানোর অভিযোগ আছে। এত টাকা দিতে না পেরে ভর্তি পরীক্ষায় অপেক্ষাকৃত বেশি নম্বর পাওয়া অনেক শিক্ষার্থী বেসরকারি কলেজে ভর্তি হতে পারে না। ফলে আসন পূরণে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে মোট স্কোর শিথিল করতে হচ্ছে। এ সুযোগে ভর্তি পরীক্ষায় লজ্জাজনক নম্বর পেয়েও হবু ডাক্তার কোর্সে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে ‘ধনীর দুলালরা’।