দেশে শ্রমআইন প্রচোলিত রয়েছে। রয়েছে শ্রমআদালতও। শ্রমআইন-আদালত শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণ করে। ক’জন শ্রমিক তা জানে? শ্রমিক ও শ্রমিক পরিবার যদি তার বা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন না হয় তাহলে তাদের অধিকার ধুলণ্ঠিত হওয়ার ঝুঁকি পদে পদে। হচ্ছেও তাই। শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ কেমন হতে হবে, কোন কাজে কতোটা নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকতে হবে, কোনো শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার ক্ষতিপূরণই বা কতো? এসব প্রশ্নের অনেকটা স্পষ্ট জবাব দেশের প্রচলিত শ্রমআইনে রয়েছে। আইনে থাকলেও আইনের বদৌলতে সেই অধিকার আদায়ের মতো সচেতন যেহেতু দেশের শ্রমিকরা নন, সেহতু শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের নিমিত্তে শ্রমআইন প্রয়োগের অঞ্চলভিত্তিক প্রতিনিধি নিযুক্তির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বটে।
কাজ করার সময় শ্রমিকের অঙ্গহানি হলে মালিকপক্ষ অধিকাংশ সময়ই শ্রমিকের অসতর্কতাকেই দায়ী করেন। কোনো কোনো মালিক ওষুধ পথ্য এবং দু একদিনের হাজিরার টাকা দিলেও তা তিনি দায়া করছেন বলেই দেখানোর চেষ্টা করেন। কাজ করার সময় শ্রমিকের প্রাণহানি? তার দায়ও বেমালুম নিহত শ্রমিকের ওপরই চাপান মালিকপক্ষ। ক্ষতিপূরণ? ওটা যে দিতে হয়, আইনগতভাবে ক্ষতিপূরণ দিতে মালিকপক্ষ যে বাধ্য তা মালিকদের অধিকাংশই তো স্বীকার করেন না। অবশ্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকার কারণে অনেক মালিক তা জানেনও না। জানলেও ক্ষতিপূরণের বদলে যদি সামাজিকভাবে নামকাওয়াস্তে কিছু অর্থ দান করে পার পান তাহলে কেন তিনি আইনগতভাবে শ্রমিকের বা তার পরিবারের হাতে ক্ষতিপূরণের অর্থ তুলে দেবেন? কিছু দিন আগে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল প্রাঙ্গণে হাসপাতালেরই সম্প্রসারিত অবকাঠামো নির্মাণকাজে নিযুক্ত এক শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। তিনি ঠিকাদারের অধীনে নিযুক্ত ছিলেন। ট্রাকের চাকার নিচে পড়া ইট বুলেটের মতো ছুটে গিয়ে ওই শ্রমিকের মাথায় লাগে। নিহত হন শ্রমিক। ওই দুর্ঘটনার জন্য ঠিকাদার ও তার অধীনে কাজ করা শ্রমিক সর্দ্দারও নিহত শ্রমিককেই দায়ী করার চেষ্টা করেন। কিন্তু নিহত শ্রমিক কি দায়ী? তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিলো কি? মালিকপক্ষের কেউ কেউ উল্টো প্রশ্ন তুলে বলতেই পারেন, শ্রমিক তার নিরাপত্তার কথা না ভেবে উজিয়ে গেলো কেন? যেখানে শ্রমিকের নিরাপত্তা নেই, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই কাজ করতে বাধ্য করা হয় সেখানে শ্রমিক কাজ করতে যায় কেন? এরকম প্রশ্নও প্রশাসনিক কোনো কোনো কর্তা করতেই পারেন? তিনি কি জানেন, দেশের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র্যসীমা রেখার অনেক নিচে বসবাস করছেন। শ্রমিক তার ও তার ওপর নির্ভরশীল পরিবারের সদস্যদের দু বেলা দু মুঠো খাবারের জন্য যখন কাজ খোঁজেন, তখন তার মুখ থেকে নিরাপত্তা প্রসঙ্গটি উত্থাপন কী আত্মঘাতী নয়? নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভালের জন্যই তো প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নিযুক্ত করা হয়েছে। তারা কি তা দেখছেন? অর্পিত দায়িত্ব পালনে কতোটুকুই আর কর্তব্যপরায়ণ?
ঝিনাইদহ ডাকবাংলা বাজারে রয়েছে শতাধিক ধান-চাতাল, অটোরাইস মিল। এসব রাইস মিলে ধান সিদ্ধ করতে বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। বাষ্পকে বিশেষভাবে বন্ধি করে সহজেই ধান সিদ্ধ করা হয়। বাষ্প যেখানে আটকানো হয় তার নাম রাখা হয়েছে বয়লার। সেই বয়লার বিস্ফোরণে অটোরাইস মিলের একটি ভবন ধসে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন দুজন শ্রমিক। গরম পানিতে ঝলসে যাওয়া দু শ্রমিককে আশঙ্কজনক অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তারা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। ঝলসে যাওয়া শ্রমিকদের চিকিৎসার্থে মালিকপক্ষ প্রাথমিক পর্যায়ে সহযোগিতার হাত বাড়ালেও নিহত দু শ্রমিকের পরিবারের ক্ষতিপূরণ কি দিয়েছেন? দেয়ার প্রতিশ্রুতিই মেলেনি। উল্টো ঘটনার পরপরই মালিক ওই বয়লার বিস্ফোরণের দায় কর্মরত শ্রমিকদের ওপরই চাপিয়েছেন। তিনি বলেছেন, শ্রমিকদের ত্রু টির কারণেই বিস্ফোরণ হয়েছে। এ কথা বলে তিনি কি পার পেতে পারেন? ঘটনার পর ঝিনাইদহ পুলিশ সুপারই শুধু নন, খুলনা বিভাগীয় পুলিশের কর্তাও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। জনপ্রতিনিধিদের ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক ও শ্রমিকদের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানালেও কারো মুখ থেকেই কেন ক্ষতিপূরণ আদায় করে দেয়ার শক্ত উক্তি উচ্চারিত হলো না?
শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে শ্রমিকদেরই সচেতন হতে হবে। সচেতনতার আলো ছড়ানোর জন্য সমাজের সচেতনমহলকে এগিয়ে আসতে হবে। শ্রমিক সংগঠনগুলোকে শুধু সাংগঠনিক শক্তি সঞ্চার করলে হবে না, শ্রমিক অধিকার সংরক্ষণে বাস্তবমুখি পদক্ষেপ নিতে হবে। যার যথেষ্ট অভাব পদে পদে পরিলক্ষিত হচ্ছে। শ্রমআইন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নতুনভাবে ভাবতে হবে। শ্রমআদালত বিভাগীয় পর্যায় থেকে জেলা পর্যায়ে নেয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়ার পাশাপাশি অঞ্চলভিত্তিক শ্রমআইন প্রয়োগকারী নিযুক্ত করার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া জরুরি। কেন না, একজন শ্রমিক একটি পরিবারের যখন একমাত্র উপার্জনক্ষম, তখন তার প্রাণহানি বা পঙ্গুত্ব ওই পরিবারকে কতোটা অসহায় করে তোলে তা ভাবতে হবে।