নিহতদের পরিবারকে এক লাখ টাকা করে অনুদান প্রদান
স্টাফ রিপোর্টার: বড়াইগ্রামে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের শোকে স্তব্ধ পুরো নাটোর। প্রিয় মানুষকে হারানোর শোক সইতে পারছে না স্বজনরা। দুর্ঘটনায় ৩৪ জন নিহত হলেও গতকাল মঙ্গলবার ৩৩ জনের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। এদিকে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দুর্ঘটনাস্থল, হাসপাতাল ও সিধুলী গ্রাম পরিদর্শন করে নিহতদের পরিবারকে এক লাখ টাকা করে অনুদান প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন।
৩৩ জনের দাফন সম্পন্ন গুরুদাসপুরের সিধুলী গ্রামে এক পরিবারের ছয়জনসহ ১৫ জন নিহত হয়েছে। গত সোমবার সন্ধ্যার পর নিহতদের একের পর এক মৃতদেহ নেয়া হয় গ্রামে। ধারাবারিষা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মো. শুকুর আলীর বাড়ির উঠোনে জমতে থাকে লাশের স্তূপ। তখন স্বজনসহ গ্রামবাসীদের কান্না-আহাজারিতে ভারী ওয়ে ওঠে পরিবেশ। আশপাশের গ্রাম থেকেও মানুষরা আসে শোক জানাতে। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় সিধুলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে ১২ জনের ও বাদ জোহর বাকি ৩ জনের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরে তাদেরকে চলনালী-সিধুলী গোরস্থানে দাফন করা হয়। জানাজা পূর্ব সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন- স্থানীয় সংসদ সদস্য অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস, উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল আজিজ ও গুরুদাসপুর পৌরসভার মেয়র শাহনেওয়াজ মোল্লা। জানাজায় এলাকার সব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ অংশ নেন। এসময় তাদের কান্নায় পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে।
গতকাল মফিজ উদ্দিন মণ্ডলের ছয় ছেলে- আতাহার হোসেন, রায়হান, রব্বেল, সোহরাব হোসেন, ছহির উদ্দিন ও কহির উদ্দিনের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। সিধুলী গ্রামে আরো যাদের দাফন হয়েছে- শিকারপুর আলিয়া মাদরাসার শিক্ষক রেজাউল করিম, মশিন্দা ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বাবুল আক্তার বাবুল, অথৈ গাড়ির চালক আলম, আজাদ বাহাদুর, শহীদ উদ্দিন, ইদাদ আলী, তোফাজ্জল, শাহেদ ও লাবু। এছাড়া শরীফ উদ্দিন, বাহাদুর, বাবলু , আব্দুল আউয়াল ও মোহনা খাতুনেরও দাফন হয়।
বড়াইগ্রাম উপজেলার পিঙ্গইনে নিহত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুসের মরদেহ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়েছে। দাফন সম্পন্ন হয়েছে সংগ্রামপুরের আব্দুর রহমান (৪৫) ও তার স্ত্রী আরিফা বেগমের, একই এলাকার বাজিতপুর গ্রামের আপন চাচা-ভাতিজা কিসমত আলীর (৪৫) ও আয়নাল হকের (৩২), জালশুকা গ্রামের মনিরুল ইসলাম ও তার ভাগ্নী সেবা ওরফে মোহনার (৮), তারানগর গ্রামের কলেজ শিক্ষক জামাল হোসেন ও তার মেয়ে জান্নাতী খাতুনের (৬) ও এলজিইডির রেজাউল করিমের (৪৫)।
এলজিইডির গুরুদাসপুর উপজেলা প্রকৌশলী হাফিজুর রহমানের (৬০) লাশ সোমবার রাতেই উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়াতে পাঠানো হয়েছে। অন্যদিকে, ফেনীর নিহত মাজদার রহমানের (৩০) লাশ তার আত্মীয়-স্বজনেরা নিয়ে গেছে। নাটোর সদর হাসপাতালে একটি লাশ রাখা আছে। লাশটির পরিচয় নিশ্চিত করা যায়নি।
অনুদানের ঘোষণা সেতুমন্ত্রীর: সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৩৪ জনের প্রত্যেক পরিবারকে এক লাখ টাকা করে অনুদান দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি সোমবার রাত একটার দিকে সিধুলী গ্রামে গেলে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। তিনি এক সপ্তার মধ্যে নগদ এক লাখ টাকা করে অনুদান দেয়ার ঘোষণা দেন। এর আগে রাত সোয়া ১২টার দিকে ওবায়দুল কাদের বড়াইগ্রামের বনপাড়ার আমিনা হাসপাতাল ও পাটোয়ারী হাসপাতালে গিয়ে আহতদের চিকিত্সার খোঁজখবর নেন এবং প্রত্যেকের চিকিত্সার ব্যয়ভার সরকার বহন করবে বলে ঘোষণা দেন। এর আগে তিনি দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
অতিরিক্ত যাত্রী বহন ও বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণেই দুর্ঘটনা: অতিরিক্ত যাত্রী বহন ও বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণেই গত সোমবার নাটোরের বড়াইগ্রামে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে প্রত্যক্ষদর্শী ও সংশ্লিষ্টরা। এদিকে কেয়া পরিবহনের বাসের পেছনে প্রাইভেটকার নিয়ে আসা বড়াইগ্রামের ব্যবসায়ী মাজেদুল ইসলাম নয়ন ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, একটি ট্রাককে ওভারটেক করতে গিয়ে কেয়া পরিবহনের বাসের সাথে অথৈ পরিবহনের ওই বাসের সংঘর্ষ হয়। অথৈ পরিবহনের ছাদে বেশ কিছু যাত্রী ছিলো। বাসের ছাদে থাকা যাত্রীরা রাস্তা ও আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। এ সময় হানিফ পরিবহনের একটি বাস সড়কে পড়ে থাকা হতাহতদের ওপর দিয়ে চলে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শী রেজাউল ও সোহেল জানান, অথৈ পরিবহন থেকে ছিটকে পড়া আট থেকে দশজন যাত্রী সড়কের ওপর পড়েছিল। তখনও কেউ কেউ কাতরাচ্ছিল। তখন হানিফ পরিবহনের একটি বাস দ্রুতগতিতে চলে যায় পড়ে থাকা হতাহত ব্যক্তিদের ওপর দিয়ে।
তদন্ত কমিটির কাজ শুরু: নাটোরের জেলা প্রশাসক মশিউর রহমান জানিয়েছেন, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নাটোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে যে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিলো, সে কমিটি কাজ শুরু করেছে। তদন্ত কমিটির প্রধান নাটোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আলী বলেছেন, সোমবার রাত থেকেই কমিটি তাদের তদন্ত কাজ শুরু করেছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না বলে জানান।
চালকদের বিরুদ্ধে মামলা: সড়ক দুর্ঘটনায় বনপাড়া হাইওয়ে থানার সার্জেন্ট মাহবুব বাদী হয়ে বড়াইগ্রাম থানায় গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় মামলা দায়ের করেছেন। বনপাড়া হাইওয়ে থানার ওসি ফুয়াদ রুহানী জানান, মামলায় কেয়া পরিবহনের চালক ঢাকার নাজিমউদ্দিনের নাম উল্লেখ করে দুজনের নামে মামলা করা হয়েছে। তিনি বলেন, অথৈ পরিবহনের চালক কে ছিলো এটা আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। তাই মামলায় তার নাম উল্লেখ করা হয়নি। তবে যিনিই গাড়িটির চালক ছিলেন, তিনিই আসামি হবেন। প্রসঙ্গত, অথৈ পরিবহনের মালিক ও চালক চাঁচকৈড় এলাকার আলম দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
জেপি’র শোক: জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং মহাসচিব ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী শেখ শহীদুল ইসলাম নাটোরে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৪ জনের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এক বিবৃতিতে জেপি’র নেতৃদ্বয় সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এ দুর্ঘটনার কারণ নির্ধারণ এবং ভবিষ্যতে এর যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে ব্যবস্থা নেয়ার জোর দাবি জানান। একই সাথে জেপি নেতৃদ্বয় যারা ইন্তেকাল করেছেন তাদের রূহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। তারা আহতদের সুচিকিত্সার জোর দাবি জানান। এছাড়া জেপি’র নেতৃদ্বয় নিহত ও আহত পরিবারবর্গের জন্য যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দানে জোর দাবি জানান।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নাটোরের দুর্ঘটনার কারণ জানতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারপরও স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত রিপোর্টে মনে হয়েছে বেপরোয়া গাড়ি চালানো ও ওভারটেকিঙের কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। গতকাল দুপুরে নাটোর থেকে ঢাকায় ফেরার পথে গাজীপুরের মৌচাক এলাকায় সড়ক পরিদর্শনে এসে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি।
এদিকে রাজশাহী অফিস জানায়, দুর্ঘটনার শিকার হয়ে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে আসা গুরুতর আহত রোগী ও তাদের স্বজনরা কর্তৃপক্ষের চিকিত্সাসেবা নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। গতকাল তারা সাংবাদিকদের বলেন, জরুরি চিকিত্সায় কোনো কার্পণ্য হয়নি। এছাড়াও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আহতদের সকল চিকিত্সা ব্যয়ভার বহন করায় অনেকটাই চাপমুক্ত তারা।
জানা গেছে, দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত ১৯ রোগী রামেক হাসপাতালে ভর্তি আছেন। অজ্ঞাত পরিচয় আরেক ব্যক্তি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দে (আইসিইউ) চিকিত্সাধীন রয়েছেন। অন্যরা হাসপাতালের ১, ৮, ৬, ৩১ ও ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিত্সাধীন রয়েছেন। শুধু ৮ নম্বর ওয়ার্ডে (নিউরোসার্জারি) ভর্তিকৃত আহতের সংখ্যা ১১। এদের প্রত্যেকে মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত বলে চিকিত্সকরা জানান। নিউরোসার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মো লুত্ফর রহমান বলেন, তার ওয়ার্ডে ভর্তিকৃতরা সবাই মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছেন। তাদের যথাসাধ্য চিকিত্সা দেয়া হচ্ছে।
রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসির উদ্দিন বলেছেন, দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিত্সা ত্রুটিমুক্ত রাখতে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আহতদের চিকিত্সা ব্যয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বহন করছে। যেসব রোগীর স্বজনরা চিকিত্সা বাবদ খরচ যেমন-হাসপাতালের বাইরে থেকে এক্সরে করা বা অন্যান্য পরীক্ষা করিয়েছেন, তাদের যথাযথ হিসাব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিতে বলা হয়েছে। নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়া-হাটিকুমরুল সড়কের রেজুর মোড়ে গত সোমবার বেলা সাড়ে তিনটায় কেয়া পরিবহন ও অথৈ পরিবহনের দুটি বাসের সংঘর্ষে ৩৪ জন নিহত হয়।