যুক্তি দেখিয়ে দায় এড়ানো নয় : দরকার বাস্তবমুখি পদক্ষেপ

বীজ নিয়ে কৃষকদের সাথে প্রতারণা নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরেই একশ্রেণির বীজ ব্যবসায়ীরা প্রকাশ্যে প্রতারণা করে আসছে। অবাক হলেও সত্য, কৃষি প্রধান দেশে মানসম্পন্ন বীজ কৃষক সাধারণের হাতে পৌঁছুনোর সুব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়নি। প্রকাশ্যে প্রতারণা করলেও কালেভাদ্রে কদাচিত ধরা পড়ে। কয়েকদিন হৈচৈ হয়। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি ওঠে। সময় গড়ানোর সাথে সাথে সময়েরই আড়ালে যেন ধামা পড়ে যায় অপরাধীর অপরাধ। তড়িত দণ্ডের ব্যবস্থা করা হলেও আইনের আলোকে শাস্তি বলতে কিছু অর্থদণ্ডের মধ্যেই সীমিত থেকে যায়। সে কারণেই ঘুরে ফিরেই কৃষকদের সাথে প্রতারণা করা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তির দৃষ্টান্তমূলক বিধান প্রণয়নের প্রসঙ্গটি উঠে আসে। আইন প্রণেতাদের কর্ণপাত হয়, হয় না। হলেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপে উদাসীনতাই পরিলক্ষিত হয়। প্রতারকদের অপতৎপরতা শুধু অব্যাহতই থাকে না, দিনদিন বাড়তে থাকে। চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর ও ঝিনাইদহসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার অবস্থাদৃষ্টে দায়িত্বশীলরাও বোধ করি এ বিষয়টি অস্বীকার করবেন না। সার, বীজ, কীটনাশক নিয়ে প্রতারণা রোধে কার্যকর পদক্ষেপের যে যথেষ্ট অভাব তাও কি অস্বীকার করা যায়?

 

মানুষ চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়ছে। হ্রাস পাচ্ছে আবাদি জমি। উজাড় হচ্ছে বন-বাদাড়। পরিবেশের ভারসাম্য নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও যা হচ্ছে তা যে মানুষের প্রয়োজনেই হচ্ছে, তা অস্বীকার করা যায় না। অতীতেও অস্বীকার করা যায়নি। যখন থেকে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে, তখন থেকে সবুজ বিপ্লবে বাংলাদেশের কৃষকেরা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছে। অবাক হলেও সত্য যে, এ বিপ্লবে সাড়া মিলেছে দেখে দেখে। আমাদের দেশের কৃষকরা সবুজ বিপ্লবই শুধু নয়, অধিকাংশ আবাদই বংশ পরমপরায় দেখে দেখেই শিখে ফসল ফলিয়ে আসছে। উৎপাদন বৃদ্ধিসহ জমির ঊর্বরতা অক্ষুণ্ণ রাখার পাশাপাশি কৃষি উপকরণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই মূলত সরকার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর করেছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে সহকারী কৃষি কর্মকর্তা নিযুক্ত করেছে। এরপরও কি আশানুরূপ সাড়া মিলেছে? কীটনাশকে ভেজাল। অল্পে কাজ হয় না বলেই মাত্রারিক্ত প্রয়োগ করে কৃষক শুধু অর্থনৈতিকভাবেই খতিগ্রস্ত হন না, মাত্রারিক্ত কীটনাশক প্রয়োগের ক্ষতিকর প্রবণতা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ প্রবণতার কারণে কৃষি উৎপাদিত পণ্যও স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। পরিবেশের বারোটা তো বাজছেই। রাসায়নিক সার প্রয়োগের ক্ষেত্রেও অসচেতনতাসহ গুণগত মান নিয়ে প্রশ্নের কারণেই মাত্রারিক্ত প্রয়োগে ডেকে আনা হচ্ছে ক্ষতি। আর বীজ? চক চকে মোড়কে নিম্নমানের বীজ ভরে নানাভাবেই কৃষকদের প্রলুব্ধ করে ঠকানো হচ্ছে। হাট-বাজারের দোকানে ভেজাল নিম্নমানের বীজ? প্রকাশ্যেই। এ প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তারা অজুহাত হিসেবে বলতেই পারেন, ‘ভালো বীজ শনাক্ত করার জন্য বস্তায় বা প্যাকেটে বিশেষ রঙের শনাক্তকরণ কাগজ লাগানো থাকে। কৃষকেরা ওগুলো দেখে কিনলেই তো ঠকেন না। খোলাবাজারে দোকানির প্রলোভনে পড়েন কেন? তাছাড়া সস্তায় কিনতে গেলে তো ঠকতেই হয়!’ যুক্তিগুলো অবশ্যই অমূলক নয়। তাই বলে যুক্তি দেখিয়ে দায় এড়ানো যায়? প্রকাশ্যে বীজ নিয়ে প্রতারণা করবে, প্রতিকার মিলবে না? পুলিশকে নকল বীজ ধরার অভিযানে নামতে দেখা যায়। চুয়াডাঙ্গা জীবননগর উপজেলার আন্দুলবাড়িয়া এলাকায় পুলিশি অভিযানে নকল ভেজাল বীজের সন্ধান মিলেছে। অবাক হতে হয়, পুলিশ আর কতোটা করবে? পুলিশের কি ভেজাল বীজ শনাক্ত করার মতো প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে? যদি এমনিতেই দক্ষ হয়ে ওঠেন তা হলে কৃষি প্রশাসনের আর দরকার কি? কৃষি উপকরণের নিরাপত্তার দায়িত্বটাও পুলিশের ওপর দিলে জাতির ভাড়ারে তো কিছু অর্থ গচ্ছিত থাকে!

 

আবাদি জমি যে কৃষকরেই হোক, সেই জমির আবাদ উপযোগিতা ওই কৃষক বিনষ্ট করতে পারেন না। তিনি নিজেও তা করতে চানও না। এরপরও কেন মাত্রারিক্ত রাসায়নিক সার, কীটনাশক প্রয়োগের প্রবণতা পেয়ে বসেছে? শুধু কি কৃষকেরই দোষ? হ্যাঁ, দোষারোপ করা যেতো যদি কৃষকদের সচেতন করার জন্য জাতি কাড়ি কাড়ি টাকা দিয়ে কৃষিবিভাগের লোকজনকে না চালাতো। বীজ কিনে আবাদ করে প্রতারিত? ক্ষতিটা শুধু কৃষকের নয়। আবাদে ক্ষতি মানে দেশের ক্ষতি। যে আবাদ দেশবাসীর চাহিদা পূরণে অবদান রাখতো, সেই অবদান তো চুলোয় গেলো, তার ওপর কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে কৃষিকাজে আগ্রহ হারালেন। বিষয়টি কোনোভাবেই খাটো করে না দেখে যথাযথ গুরুত্ব দিয়েই কৃষি প্রশাসনকে দায়িত্বশীল হতে হবে। ভালো-মন্দ শনাক্তকরণের গোলাপি হলুদ কাগজ ঝুলিয়েই দায়িত্ব এড়ানো যায় না। ওই কাগজ লাগানো বীজ বিক্রি হচ্ছে নাকি অন্য বীজেই ভরে রাখা হয়েছে দোকান তা দেখার দায়িত্বও কর্তাদের। একই সাথে দরকার, কৃষকদের সাথে যারা সার, বীজ, কীটনাশক দিয়ে প্রতারণা করছে বা করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। প্রয়োজন জবাবদিহিতা।

Leave a comment