স্টাফ রিপোর্টার: সরকারি স্বাস্থ্যসেবা তৃণমূলে আরো আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর করতে ‘ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা’ কার্যক্রমে রোগীরা সেবা পাওয়ার চেয়ে সেখানে সরকারি টাকার অপচয় বেশি হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কার্যক্রমগুলো পরিচালনার জন্য বাজেটে বরাদ্দ এবং লোকবল নিয়োগে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আগ্রহ থাকলেও কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে না রোগীরা। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রতিদিন কতোজন রোগী সেবা পাচ্ছে, তা লিখে রাখার নির্দেশ থাকলেও এই তথ্য নেই কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে থাকা কোনো কর্মকর্তার কাছে। সেবা দেয়ার তথ্য নেই কোনো হাসপাতালেও। নেই কার্যক্রম পরিচালনার কোনো নীতিমালা। কার্যক্রম পরিচালনায় দায়িত্বরতদের জবাবদিহিতার চেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাদের উপকরণ কিনে দেয়া এবং বাজেটে বরাদ্দ দিতে বেশি আগ্রহী বলেও অভিযোগ আছে। তবে সংশ্লিষ্ঠদের দাবি, কার্যক্রম চালু হয়েছে। প্রযু্ক্তির ব্যবহারে অভ্যস্ত হওয়ার সাথে সাথে সচেতনতা বাড়লে সুফল মিলবে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মতে, সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অনেক চিকিৎসক উপস্থিত না থাকায়, তৃণমূলের কর্মস্থল ফেলে তারা ঢাকামুখি হওয়ায় এবং হাসপাতালের অনেক কর্মকর্তার প্রযুক্তি ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা না থাকায় রোগীরা ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমের সুফল প্রত্যাশা অনুযায়ী পাচ্ছে না। হাসপাতালের অনেক কর্মকর্তার অভিযোগ, প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে জানাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ পর্যন্ত প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় তারা উপকরণ ব্যবহার করতে পারছেন না।
অনুসন্ধান বলছে, চিকিৎসকদের অনুপস্থিতির পাশাপাশি মন্ত্রণালয়ের কাছে এ বিষয়ে তাদের জবাবদিহিতার ব্যবস্থা কঠোর না থাকায় ডিজিটাল কার্যক্রমগুলো চলছে ধীরগতিতে। এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নসহ সরকারি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে চিকিৎসকদের মফস্বলের কর্মস্থলে থাকতে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে কয়েকবার অনুরোধ করা এবং নির্দেশ দেয়া হলেও অনেক চিকিৎসক তা আমলে নেননি। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল হান্নানের দাবি, সরকারের কোনো কার্যক্রম বাস্তবায়নে চিকিৎসক ও কর্মকর্তাদের অবহেলা বা অনীহার সুযোগ নেই।
তথ্যমতে, মোবাইলফোন, টেলিমেডিসিন আর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রোগীদের চিকিৎসাসেবা এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ দেয়ার লক্ষ্যে ২০০৯ সাল থেকে সরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে চালু হয় ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম। এসব কার্যক্রমের আওতায় সারাদেশের ৪৮২টি হাসপাতালে চালু আছে ‘মোবাইলফোনে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম’। ২০০৯ সালের মে মাসে এই কার্যক্রম চালু হয়। চিকিৎসাকেন্দ্রে রোগীরা উপস্থিত না হয়েও মুঠোফোনের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ যেন পান এ উদ্দেশ্য থেকে চালু হয় কার্যক্রমটি। রোগীর চাপে থাকা সরকারি হাসপাতালে এই কার্যক্রম চালু হলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা একে সাধুবাদ জানান।
কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তখন সারাদেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালে প্রতিটি ৫ হাজার টাকা দামের মোট ৪৮২টি মোবাইলফোন কিনে দেয়া হয়। কার্যক্রম শুরুর কয়েক মাস পর থেকে অভিযোগ উঠতে থাকে, হাসপাতালের নির্ধারিত মুঠোফোন নাম্বারটি প্রায় সময়ই বন্ধ থাকে। ফোন করলে চিকিৎসকের বদলে অনেক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তা রিসিভ করেন কর্মচারীরা। ফোনে পরামর্শ চাইলে অনেক কর্মচারী রোগীকে যোগসাজশের বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দেন বলেও অভিযোগ আছে।
সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবার মানের ব্যাপারে রোগী এবং তাদের স্বজনদের তাৎক্ষণিক অভিযোগ বা পরামর্শ জানতে ২০১০ সাল থেকে চালু হয় ‘এসএমএসে অভিযোগ’। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দাবি, ৪৮২টি সরকারি হাসপাতালের দেয়ালে একটি করে সাইনবোর্ড লাগানো আছে। কীভাবে খুদেবার্তা (এসএমএস) পাঠাতে হবে, তা সাইনবোর্ডে লেখা আছে। ওই বর্ণনা অনুসরণ করে খুদেবার্তা পাঠাতে হয়। তবে উপজেলা পর্যায়ের অনেক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সাইনবোর্ড আজ পর্যন্ত টানানো হয়নি এ তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে আছে বলেও জানান প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন কর্মকর্তা। এছাড়া ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, খুদেবার্তা পাঠিয়েও প্রায় সময় প্রতিকার পাওয়া যায় না। মোবাইলফোন নম্বরও বন্ধ থাকে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শর্ত অনুযায়ী, প্রতিদিন কয়টি ফোন রিসিভ করা হলো, রোগী কী ধরনের পরামর্শ চাইলেন, সেসব তথ্য লিখে রাখতে হবে। তবে দেশের কোনো হাসপাতালেই এ তথ্য নেই বলে জানা গেছে। তবু প্রতি মাসে সব মুঠোফোন মিলিয়ে ২ লাখ ৪১ হাজার টাকা বিল আসছে।
অন্যদিকে, ‘ভিডিও কনফারেন্স’ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২০০৯ সালের এপ্রিলের আগে সারাদেশের চিকিৎসাকেন্দ্রে ৮০০টি কম্পিউটার কিনে দেয় সরকার। ২০০৮-২০১১ সাল পর্যন্ত মেয়াদের এইচএনপিএসপি প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে ৭ কোটি ২৬ লাখ ৫৪ হাজার টাকায় কম্পিউটারগুলো কেনা হয়। পাশাপাশি তখন ইন্টারনেট সংযোগও দেয়া হয়। চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোর কাজ ও সেবার মান সম্পর্কে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে তথ্য বিনিময়ও কার্যক্রমটির উদ্দেশ্য। অনেক স্বাস্থ্য কর্মকর্তার অবহেলা এবং তারা ইন্টারনেট ব্যবহার করতে না পারায় এই কার্যক্রমেও অপচয় হচ্ছে। তাদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর। ব্যবহার না হওয়ায় অনেক কম্পিউটার ইতোমধ্যে অকেজো পড়ে আছে। তবে মাস শেষে ইন্টারনেট সংযোগের বিল নিচ্ছেন সবাই।
ইন্টারনেট সংযোগের কারণে মাসে প্রতিটি কম্পিউটারে বিল আসছে প্রায় ৮০০ টাকা করে। সব মিলিয়ে তা হয় ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এই হিসাবে এ পর্যন্ত বিল এসেছে সাড়ে ৬ কোটি টাকার বেশি। গত বছরের শেষ দিক থেকে শুরু করে চলতি বছরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত দেশের সাড়ে ১২ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে পাঠানো হয় ১২ হাজার ৪৭১টি ল্যাপটপ। ব্যবহার সম্পর্কে প্রশিক্ষণ না থাকায় অনেক কমিউনিটিকর্মী ল্যাপটপ পেয়েও কাজে লাগাতে পারছেন না।
এছাড়া ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমের আওতায় ৬৪টি জেলার সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে ‘ভিডিও কনফারেন্স’ আছে। এই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ৬টি বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকসহ ৬৪টি সিভিল সার্জন কার্যালয়ে ওয়েব ক্যামেরা দেয়া হয় ২০১০ সালে। কার্যক্রমটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। দেশ-বিদেশে আলোচিত এই কার্যক্রম ঠিকমতো পরিচালনা করছেন না বলে কয়েকজন বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ও সিভিল সার্জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। তবে এই কার্যক্রমকে আরো সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সম্প্রতি দেশের সব হাসপাতালে ওয়েব ক্যামেরা দেয়ার এবং থ্রিজি টেলিফোন সেবা চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
তথ্যমতে, ২০১০ সালে সরকারি হাসপাতালে চালু হয় ‘টেলিমেডিসিন কার্যক্রম’। বিশেষায়িত, জেলা, উপজেলা আর ২২টি ইউনিয়নের স্বাস্থ্যকেন্দ্র মিলিয়ে ৩০টিতে চালু আছে এই কার্যক্রম। কার্যক্রমটি চলছে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল, সাতক্ষীরা জেলা হাসপাতাল, নীলফামারী জেলা হাসপাতাল, গোপালগঞ্জ জেলা হাসপাতাল, পীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, দাকোপ উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং দেবহাটা উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রসহ ইউনিয়ন পর্যায়ের ২২টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে কার্যক্রমটি পরিচালনায় যতো টাকা খরচ হচ্ছে, ততো টাকা মানের সেবা রোগীরা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।