মহাসিন আলী/সেখ শফি: মেহেরপুর জেলার দক্ষিণাঞ্চল বলে খ্যাত ঐতিহ্যবাহী শেখ ফরিদের আশির্বাদ পুষ্ট দরগা গ্রাম বাগোয়ান এবং তার পার্শ্ববর্তী আনন্দবাস, তারানগর, জয়পুর, বল্লভপুর, রতনপুর, ঢোলমারী, রশিকপুর, টেংরামারী ও পরানপুরসহ ২৫/৩০টি নিবিড় পল্লি অধ্যুষিত গ্রাম। এলাকার মানুষের একমাত্র পারাপারের মাধ্যম ভৈরব নদের কুঠির ঘাট। যেখানে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বিভিন্ন প্রয়োজনে পারাপার হয়ে থাকেন। জরাজীর্ণ বাঁশের অপরিকল্পিতভাবে তৈরি ঝুঁকিপূর্ণ সাঁকো তথা ফরাশ দিয়ে ওইসব মানুষের চলাচল করতে হয়। যেখানে প্রতিদিন পারাপারে দেখা যায় বেশ কয়েকজন মানুষ কোনো না কোনোভাবে দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছেন। বিশেষ করে স্কুল-কলেজ ও মাদরাসাগামী কোমলমতি ছাত্রছাত্রীরা বেশি দুর্ঘটনার শিকার হয়।
মেহেরপুর জেলা সদরের সাথে যোগাযোগের একমাত্র পারাপারের রাস্তা হিসেবে এলাকার জনমানুষ অনায়াসে অল্প সময়ে যাতায়াত করতে পারছে না। এমন কি এলাকার মানুষেরা কৃষিজাত দ্রব্য বিভিন্ন হাটে-বাজারে ও জেলা শহরে সরবরাহ করতে সক্ষম হচ্ছেন না শুধুমাত্র পারাপারের সমস্যার কারণে।
এলকার মানুষের নিকট কুঠির ঘাটের গুরুত্ব জানতে চাইলে তারা বলেন, কুঠির ঘাটটি এলাকার মানুষের পারাপারের জন্য ব্রিটিশ আমল থেকে চালু আছে। যা এখনও পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। তাদের জানা মতে, এ ঘাট দিয়ে পার হয়ে বাংলার স্বাধীন শেষ নবাব সিরাজউদৌল্লার দাদা আলিবদ্দীন খান বর্তমান মেহেরপুর সদর উপজেলার আমদহ ইউনিয়নের ভবানন্দপুর গ্রামের তথাকথিত তৎকালীন ব্রিটিশ শাসন আমলের রাজধানীতে যাতায়াত করতেন।
এ কুঠির ঘাটের ওপরে দক্ষিণ পাশে নদের কুল ঘেষে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসন আমলে গড়ে উঠেছিলো খ্রিস্টান মিশন হাসপাতাল যা পরিচালনা করতেন এক ইংল্যান্ড নাগরিক মি. বারকোট। হাসপাতালের ঐতিহ্য রক্ষায় ও স্মৃতি ধরে রাখতে ওই ঘাটের নামকরণ করা হয় কুঠির ঘাট। এলাকার বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক সমস্যার কারণে হাসপাতালটি মুজিবনগরের বল্লভপুর খ্রিস্টান কমিউনিটিতে স্থানান্তর করা হয় যা বর্তমানে ইংল্যান্ডের এক মহিয়সী নারী মেরী রোজের তত্ববধানে পরিচালিত হচ্ছে। এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের নিকট যতোদূর জানা যায়, কুঠির ঘাট দিয়ে তাদের দেবতা মা লক্ষ্মী পার হয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছেন। মা লক্ষ্মী ওই ঘাট দিয়ে পার হওয়ার কারণে ওই ঘাটের অদূরে নদীর তীরে রশিকপুরের এক পুরাতন পাকড় গাছের নিচে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা প্রতি বছর পূজা অর্চনা করে থাকেন। রশিকপুর গ্রামের হিন্দু পাটনী শ্রী বাসুদেব বলেন, আমাদের পাঁচ পুরুষ ওই ঘাটে সাধারণ মানুষকে পারপার করে আসছি। পূর্বে আমরা গরুর গাড়িসহ ছোটখাট যানবাহন পারাপারের জন্য চাপ নৌকা ব্যবহার করতাম। কালের বিবর্তনে নৌকাসহ বাঁশের সাঁকো ব্যবহার করে মানুষ পারাপার করে থাকি।
এলাকার বেশ কিছু লোক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিগত সময়ে ওই ঘাটে ব্রিজ করার জন্য ১০/১২ বার ওপর থেকে লোক এসে মাপজোক করে গেছেন। তার পরও কোনো কাজ হয়নি। তারা আরও বলেন, বিগত জোট সরকারের আমলে কুঠির ঘাটে ব্রিজ না করে মাত্র ১০০ গজের ব্যবধানে মুজিবনগর উপজেলার ভবানীপুর ও শিবপুরে ভৈরব নদীর ওপর দুটি ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। যা মাত্র দু একটি গ্রামের মানুষের উপকারে আসছে। অথচ যে ঘাট দিয়ে ২৫/২০টি গ্রামের মানুষ যানবাহন নিয়ে পারাপার হতে পারতো সেই ঘাটতি হতে পারতো কুঠির ঘাট। এলাকাবাসী মনে করে, মেহেরপুর জেলার পারাপারের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাটের মধ্যে কুঠির ঘাট একটি। যেখানে ব্রিজ নির্মাণে কোনো গুরুত্ব দেখানো হয়নি।
এলাকাবাসী আরও জানায়, মুজিবনগর উপজেলার মোনাখালী ও মহাজনপুর ইউনিয়নের বেশ কিছু অংশের সাথে মুজিবনগর থানা পুলিশের সরাসরি যোগাযোগের ব্যবস্থা নেই। ওইসব এলাকায় কোনো অঘটন ঘটলে পুলিশ যেতে প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগে। ওইসব এলাকা সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য হলেও এলাকার মানুষের কিছু করার থাকে না। নিরূপায় ওই এলাকার মানুষকে সন্ত্রাসীদের ভয়ে ভীতু হয়ে রাত কাটাতে হয়।
এলাকার মানুষের আশা, সরকার ভৈরব নদের ওপর কুঠিঘাটে দ্রুত ব্রিজ নির্মাণ করে এলাকার মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করবেন।