সংসদে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিল উত্থাপন

 

 

স্টাফ রিপোর্টার: বিচারপতিদেরঅভিশংসনের (অপসারণ) ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে ফিরিয়ে আনতে বহুল আলোচিতসংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিল জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হয়েছে। গতকাল রোববার বিলটিউত্থাপন করেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়কমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। পরে এটিঅধিকতর যাচাই-বাছাইয়ের জন্য এ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতেপাঠানো হয়। প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা বিলেরওপর কোনো আপত্তি উত্থাপন করেননি। বরং তারা হাত তুলে এতে সমর্থন জানান।উত্থাপিত বিলটিতে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপন ও সংশোধনের প্রস্তাবকরা হয়েছে। এতে বিচারপতিদের অপসারণে রাষ্ট্রপতির একক ক্ষমতা খর্ব করাহয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন- বিলটি পাস হলে, প্রমাণিত অসদাচরণ বাঅসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশগরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে বিচারককে অপসারিত করা যাবে।তবে কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতিসংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। এছাড়াও কোনো বিচারক রাষ্ট্রপতির কাছেস্বাক্ষরযুক্ত পত্রে পদত্যাগ করতে পারবেন।

১৮ আগস্ট সংবিধানের ষোড়শসংশোধনী সংক্রান্ত বিলটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পায়। এরপর আইন মন্ত্রণালয়থেকে মঙ্গলবার সংসদ সচিবালয়ের আইন শাখায় বিলটি জমা দেয়া হয়।প্রস্তাবিতবিলে বিচারপতি অপসারণে রাষ্ট্রপতির একক ক্ষমতা আর থাকছে না। বর্তমানসংবিধানের ৯৬-এর ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- যে ক্ষেত্রে কাউন্সিল অথবা অন্যকোনো সূত্র হইতে প্রাপ্ত তথ্যে রাষ্ট্রপতির এইরূপ বুঝিবার কারণ থাকে যেকোনো বিচারক (ক) শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে তাহার পদের দায়িত্বসঠিকভাবে পালন করিতে অযোগ্য হইয়া পড়িতে পারেন, অথবা (খ) গুরুতর অসদাচরণেরজন্য দোষী হইতে পারেন, সেই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি কাউন্সিলকে বিষয়টি সম্পর্কেতদন্ত করিতে ও উহার তদন্ত ফল জ্ঞাপন করিবার জন্য নির্দেশ দিতে পারেন।

৯৬-এর৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- কাউন্সিল তদন্ত করিবার পর রাষ্ট্রপতির নিকট যদিএইরূপ রিপোর্ট করেন যে, উহার মতে উক্ত বিচারক তাহার পদের দায়িত্ব সঠিকভাবেপালনে অযোগ্য হইয়া পড়িয়াছেন অথবা গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হইয়াছেন তাহাহইলে রাষ্ট্রপতি আদেশের দ্বারা উক্ত বিচারককে তাহার পদ হইতে অপসারিতকরিবেন।’

নতুন বিলে এসব ধারা বিলুপ্ত করা হয়েছে। এতে নতুন দুটি ধারাযুক্ত করা হয়েছে। ৯৬-এর ২-এ বলা হয়েছে- ‘প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যেরকারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারাসমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোনোবিচারককে অপসারিত করা যাইবে না।’ ৩-এ বলা হয়েছে- ‘এই অনুচ্ছেদের (২) দফারঅধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্যসম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করিবেন।’

এদিকেবর্তমান সংবিধানের ৯৬-এর ১-এ বিদ্যমান ‘এই অনুচ্ছেদের নিম্নরূপ বিধানাবলীব্যতীত কোনো বিচারককে তাহার পদ হইতে অপসারিত করা যাইবে না।’ এবং ৮-এবিদ্যমান ‘কোনো বিচারক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করিয়া স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগেস্বীয় পদ ত্যাগ করিতে পারিবেন।’ ধারা দুটি প্রস্তাবিত বিলে ঠিক রাখা হলেও২, ৩, ৪ ও ৭ ধারা পুরোপুরি বিলুপ্ত করা হয়েছে। বিলুপ্ত ৩ ধারায় আছে- ‘একটিসুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল থাকিবে যাহা এই অনুচ্ছেদে কাউন্সিলবলিয়াউল্লেখিত হইবে এবং বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকের মধ্যেপরবর্তী যে দুজন কর্মে প্রবীণ তাহাদের লইয়া গঠিত হইবে। তবে শর্ত থাকে যে, কাউন্সিল যদি কোনো সময়ে কাউন্সিলের সদস্য এইরূপ কোনো বিচারকের সামর্থ্য বাআচরণ সম্পর্কে তদন্ত করেন, অথবা কাউন্সিলের কোনো সদস্য যদি অনুপস্থিত থাকেনঅথবা অসুস্থতা কিংবা অন্য কোনো কারণে কার্য করিতে অসমর্থ্য হন তাহা হইলেকাউন্সিলের যাহারা সদস্য আছেন তাহাদের পরবর্তী যে বিচারক কর্মে প্রবীণতিনিই অনুরূপ সদস্য হিসেবে কার্য করিবেন।’(৪) ‘কাউন্সিলের দায়িত্বহইবে- (ক) বিচারকদের জন্য পালনীয় আচরণবিধি নির্ধারণ করা, এবং (খ) কোনোবিচারকের অথবা কোনো বিচারক যেরূপ পদ্ধতিতে অপসারিত হইতে পারেন সেইরূপপদ্ধতি ব্যতীত তাহার পদ হইতে অপসারণযোগ্য নহেন এইরূপ অন্য কোনো পদে আসীনব্যক্তির সামর্থ্য বা আচরণ সম্পর্কে তদন্ত করা।’ (৭) ‘এই অনুচ্ছেদের অধীনেতদন্তের উদ্দেশে কাউন্সিল স্বীয় কার্য-পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করিবেন এবংপরওয়ানা জারি ও নির্বাহের ব্যাপারে সুপ্রিমকোর্টের ন্যায় উহার একই ক্ষমতাথাকিবে।’ প্রস্তাবিত বিলে এসব ধারা বিলুপ্ত করে দেয়া হয়েছে। সংবিধানের ষোড়শসংশোধনের কারণ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিলটিতে বলা হয়েছে, গণপ্রজাতন্ত্রীবাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭-এর বিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের সবক্ষমতার মালিক জনগণ এবং তাদের পক্ষে এই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল সংবিধানের অধীনও কর্তৃত্বে কার্যকর হবে। এর প্রতিফলনে ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানেরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত রাষ্ট্রপতিকে সংসদ কর্তৃক অভিশংসনেরমাধ্যমে অপসারণ (অনুচ্ছেদ ৫২), সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারালেপ্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ (অনুচ্ছেদ ৫৭), সংসদ সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থিতপ্রস্তাবের মাধ্যমে স্পিকারকে অপসারণ (অনুচ্ছেদ ৭৪) এবং সংসদের মোট সদস্যসংখ্যার দু-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত প্রস্তাবের মাধ্যমেসুপ্রিমকোর্টের বিচারকদের অপসারণের বিধান (অনুচ্ছেদ ৯৬) ছিলো।

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকারকে, যথাক্রমে অভিশংসন, পদত্যাগ ও অপসারণ সম্পর্কিতপূর্ববর্তী বিধান এখন পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকলেও সামরিক শাসকের মাধ্যমেঅসাংবিধানিক পন্থায় সামরিক ফরমানের মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্টের কোনো বিচারকেরঅসদাচরণ বা অসামর্থ্যের অভিযোগে সংসদের মাধ্যমে অপসারণের বিধানপরিবর্তনক্রমে সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং অপর দুজন প্রবীণবিচারকের সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম জুডিসিয়াল কউন্সিলের ওপর ন্যস্ত করা হয়, যাসংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭-এর চেতনার পরিপন্থী। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরমাধ্যমে গঠিত সংসদে রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গের মতো উচ্চ আদালতের বিচারকদেরজবাবদিহিতার নীতি বিশ্বের অধিকাংশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিদ্যমান রয়েছে। এইপ্রেক্ষাপটে, ১৯৭২ সালের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৬ পুনঃপ্রবর্তনের মাধ্যমেসুপ্রিমকোর্টের বিচারকদের সংসদের মাধ্যমে অপসারণের বিধান পুনঃপ্রবর্তনেরমাধ্যমে অনুচ্ছেদ ৭-এর চেতনা পুনর্বহালের লক্ষ্যে জাতীয় সংসদে সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) আইন-২০১৪ এর উত্থাপন করা হয়েছে। বিলটি আইনে পরিণত হলেস্বাধীন বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা আরও বৃদ্ধির পাশাপাশিজনপ্রতিনিধির নিকট তার জবাবদিহিতা থাকা সংক্রান্ত সংবিধানের মৌলিক কাঠামোসমুন্নত থাকবে। উল্লেখ্য, ১৯৭২-এর সংবিধানের বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতাসংসদের হাতেই ছিল। ১৯৭৪ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর সময় এ ক্ষমতারাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়। পরে জিয়াউর রহমানের সময় এক সামরিক আদেশেবিচারপতিদের অভিশংসনের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হয়। নবমসংসদেও বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়েআলোচনা হয়। ২০১১ সালে এ বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। পরের বছর ২০১২ সালেতৎকালীন স্পিকার মোঃ আবদুল হামিদের একটি রুলিংকে কেন্দ্র করে হাইকোর্টেরএকজন বিচারপতিকে অপসারণের দাবি তোলেন কয়েকজন সংসদ সদস্য। তখন থেকেইবিচারপতিদের ক্ষমতা ফিরিয়ে আনার দাবি ওঠে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর জন্যগঠিত বিশেষ কমিটি এ বিষয়ে সুপারিশ করলেও শেষ পর্যন্ত তখন এই সংশোধনীটি আনাহয়নি।