দেশের কতোজন নারীকে পড়শি দেশ ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়েছে? পরিসংখ্যান নেই। ভারত থেকে দেশে ফেরত দেয়া বা আনা নারীর সংখ্যা যে হারে বাড়ছে তা চমকে ওঠার মতোই। শুধু ভারত থেকে ফেরত আনা হচ্ছে তাও নয়, পাচারমুখি বহু নারী সীমান্তরক্ষী বিজিবির তৎপরতায় পাচার থেকে রক্ষাও পাচ্ছে। রক্ষা পাওয়া নারীও অসংখ্য। মধ্যপ্রাচ্যে পাচার হওয়া নারীর সংখ্যাও কম নয়। অথচ দেশে সরকারি-বেসরকারিভাবে দীর্ঘদিন ধরেই নারী ও শিশু পাচার রোধে নানামুখি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এরপরও নারী পাচার রোধে কাঙ্ক্ষিত সফলতা মিলছে না কেন? শুধুই কি দারিদ্র্য? অসচেতনতা ও উচ্চাভিলাসী মানসিকতাও বহুলাংশে দায়ী।
নারী ও শিশু পাচারকারী চক্র সমাজেই কৌশলে ঘুর ঘুর করছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এরা ভালো এবং মোটা অঙ্কের টাকার বেতনের চাকরির প্রলোভনে ফেলে। পাচারকারীদের শিকার মূলত দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত পরিবারের যুবতিসহ স্বামী পরিত্যক্তা। এদের মধ্যে যারা উচ্চাভিলাসী তারা সহজেই পাচারকারীদের প্রলোভনে পড়ে পাচার হয়ে অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হন। হাতে গোনা কিছু থাকে যারা অভিমানে রাস্তায় বেরিয়ে পাচারকারীদের কবলে পড়েন। যেমন চট্টগ্রামের নাজমা। চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নারী পাচার হচ্ছে। পাচার হওয়া নারীদের অধিকাংশকেই বন্দি হয়ে যৌনসহ নানা পদের নির্যাতনের শিকার হতে হয়। ফেরার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। চরম এ সত্যটা দরিদ্রপিষ্ট পরিবারের যুবতিদের অনেকেই আগে উপলব্ধিতেও নিতে পারেন না। কারণ তাদেরকে পাচারকারীরা এমনভাবে প্রলুব্ধ করে যে তাদের কথা বিশ্বাস করে অন্ধকারে ঝাঁপ দিতে পিছু পা হন না।
নারী ও শিশু পাচার রোধে দেশে প্রচলিত আইন বেশ কঠোর। আইন থাকলেই হয় না, তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হয়। পাচার হওয়া নারীদের অধিকাংশই যেহেতু দরিদ্র্য পরিবারের সেহেতু তাদের পিতা-মাতা আইনের পথে হাঁটতে খুব বেশি আগ্রহী হন না। পাচার হয়ে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে বাড়ি ফিরলেও কেউ কেউ লোকলজ্জায় মুখ খোলেন না। হাতে গোনা কিছু নারী আইনের আশ্রয় নিয়ে পাচারকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানালেও পাচারকারীদের প্রভাবে পুলিশি তদন্তে গড়িমসিতে অনেক ক্ষেত্রেই বিচার প্রার্থী হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেন। নারী ও শিশু পাচার রোধে আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে পাচারকারীদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রয়োজন সচেতনতা সৃষ্টি। অবশ্য দারিদ্র্যের কষাঘাতের কাছে উপদেশবাণী কতোটুকুই আর পাত্তা পায়? সে কারণেই দারিদ্র্য বিমোচনে নানামুখি পদক্ষেপ প্রয়োজন। নারী শিক্ষা সম্প্রসারণে সরকারের বিশেষ উদ্যোগ বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত। নারী শিক্ষার সুযোগ কাজে লাগাতে অভিভাবকদের যেমন আন্তরিক হওয়া দরকার, তেমনই দরকার নারীদের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা। তা কি হবে?
দেশে যেটুকু কর্মসংস্থান গড়ে উঠেছে তার প্রায় সবই রাজধানী কেন্দ্রিক। কিছু আছে বিভাগীয় পর্যায়ে আর জ্বালানি সুবিধাপূর্ণ এলাকায়। তাতেও কি নারী শ্রমিকদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেয়া হচ্ছে? মাঝে মাঝেই গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলনের মধ্যদিয়ে যে চিত্র ফুটে ওঠে তা সুখকর নয়। চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় কর্মসংস্থান গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। কিছু গড়ে উঠলেও জ্বালানি সমস্যাসহ প্রতিকুল পরিবেশ শিল্প কলকারখানা স্থানান্তর করে ছেড়েছে। শুধু নারী পাচার রোধে নয়, সমাজ থেকে অপরাধপ্রবণতা দূর করতেও দরকার পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান। অঞ্চলভিত্তিক কর্মসংস্থান তথা শিল্প গড়ে তোলার উদ্যোগের বড্ড অভাব। সুদিন আসবে কীভাবে?