মো. শাহাবুদ্দিন: চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদার সীমান্তবর্তী কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছে শ শ চুল প্রসেসিঙের কারখানা। নারী-পুরুষ কাজ করে আয় করছে হাজার হাজার টাকা।
জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা দামুড়হুদা উপজেলার কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন গ্রামে ৭-৮ বছর আগে কতিপয় যুবক নিজ উদ্যোগে গড়ে তোলেন চুল প্রসেসিং কারখানা। পরবর্তিতে তাদের দেখাদেখি অনেকেই গড়ে তোলেন এ কারখানা। বর্তমানে কুতুবপুর, মুন্সিপুর, জাহাজপোতা, শিবনগর, হরিরামপুর, কানাইডাঙ্গাসহ সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে প্রায় ৫’শ থেকে ৬’শ কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানায় হাজার হাজার নারী-পুরুষ একসাথে কাজ করছেন। কোনো শ্রমিক মাসিক বেতনের চুক্তিতে আবার কেউবা দৈনিক হাজিরায় কাজ করে যাচ্ছেন। এসব কারখানায় একজন দক্ষ শ্রমিকের বেতন ৬ হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। মহিলা শ্রমিকেরা মূলতো চুক্তিবদ্ধভাবে গুঁটি চুল বাছাই এবং পরিষ্কারের কাজ করে থাকেন। প্রতি ১০০ গ্রাম গুঁটি চুল বাছাই এবং পরিষ্কার করতে তারা পেয়ে থাকেন ৪০-৫০ টাকা করে। সেই হিসেবে একজন মহিলা শ্রমিক মাসে এ কাজ করে ১৮’শ থেকে ২৫’শ টাকা আয় করেন। কারখানাগুলো ঘুরে দেখা যায়, এখানকার শ্রমিকেরা একে অপরের সাথে পাল্লা দিয়ে কাজ করে চলেছেন। এতে যেমন কারখানারমালিক লাভবান হচ্ছে ঠিক তেমনি হাজার-হাজার পরিবারের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।
এক সময় এসব এলাকার নারী-পুরুষেরা সীমান্তে চোরাচালানকাজে লিপ্ত ছিলেন। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া স্থাপনের কারণে তারা একসময় অনেকটাই বেকার হয়ে পড়েন। ঢাকা, কুমিল্লা, নঁওগা, বরিশাল, চিটাগাং এলাকায় চুলের কারবারের কথা শুনে তারা দলে দলে স্থানীয়ভাবে ফেরী করে গুঁটি চুল সংগ্রহ করে কেনা-বেচা করতে থাকেন। এ ব্যবসায়ে লাভ হওয়ার কারণে এবং এর ব্যাপক চাহিদা দেখে তারা চুল প্রসেসিং কারখানা করতে উদ্যোগী হয়ে তাদের মহাজনদের পরামর্শক্রমে নিজেরাই কারখানা গড়ে তোলেন। ২০০৩ সালের শেষের দিকে মাত্র কয়েকটা ছোট কারখানা তৈরির মাধ্যমে শুরু হয় এ এলাকার চুল প্রসেসিং কারখানা। আর আজ সীমান্তবর্তী এসব এলাকায় গড়ে উঠেছে প্রায় ৫’শ থেকে ৬’শ টির মতো ছোট-বড় কারখানা যা কর্মসংস্থান যোগাচ্ছে প্রায় ১০ হাজারের মতো পরিবারের। প্রতিদিন পরিবহনযোগে শ শ কেজি গুঁটিচুল চলে আসছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসব এলাকায়।
চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের কুতুবপুর গ্রামের কারখানা মালিক মনির হোসেন জানান, প্রথমে তিনি ৩-৪ কেজি চুল দিয়ে কারখানা শুরু করেন। বর্তমানে তার কারখানায় প্রতিদিন ১০ কেজি চুলের কাজ করা হয়। পুরুষ এবং মহিলা শ্রমিক মিলে প্রায় ৫০-৬০ জন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করছে তার কারখানায়। চুলের মহাজনদের কাছ থেকে গুঁটি চুল আনার পর থেকে রেমি চুল প্রস্তুত করা পর্যন্ত নারী-পুরুষ উভয়ই দক্ষতার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন।
এ গুঁটি চুল প্রথমে মহিলা শ্রমিকের মাধ্যমে গুঁটি ছাড়িয়ে আলাদা করে প্রাথমিক পরিষ্কার এবং বাছাই কাজ করা হয়। এরপর এ বাছাই করা চুলগুলো ডিটার্জেন্ট পাওডার ও শ্যাম্পু দিয়ে পানিতে ভিজিয়ে রেখে পরিষ্কার করা হয়। দ্বিতীয়বারের মতো পরিষ্কার করা এ চুল কারখানার ভেতরে নিয়ে কাটিং মেশিনের মাধ্যমে কাচি করা হয়। কাচি করা চুলগুলোকে একই সাথে রাবার দিয়ে ছোট ছোট গোছায় বেঁধে আলাদা করা হয়। কারখানায় এ ছোট ছোট গোছা করা চুলগুলোকে বলা হয় নচি/লাচি। এবার এ নচি/লাচি করা চুল পূনরায় শ্যাম্পু ও কন্ডিশনার ব্যবহার করে ধৈত করে বাতাশে শুকানো হয়। শুকিয়ে চুল যখন উজ্জ্বল হয় তখন এগুলোকে শেষবারের মতো কাটিং মেশিনে নেয়া হয় ফিতা দিয়ে মেপে গ্রেডিং করে রেমি তৈরির জন্য। এ রেমি করা চুলই কারখানা থেকে বিক্রির জন্য প্রস্তুতকৃত চুল।
রেমিচুলের দৈঘ্যের ওপরই এর মূল্য নির্ভর করে। চুল যতো লম্বা হবে বাজার দরও ততো বেশি হবে। চুলের এ দৈর্ঘ্যের ওপর ভিত্তি করে এর বাজার মূল্য সর্বনিম্ন ৬ হাজার টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১৮ হাজার টাকা কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। ২২ সে.মি থেকে ২৭ সে.মি লম্বা চুলকে সর্বোচ্চ গ্রেডের চুল বলা হয়।
চাইনা থেকে বায়াররা সরাসরি কারখানায় এসে তাদের কমিশনভুক্ত লোকের মাধ্যমে এ চুল কিনে নিয়ে যায়। তাই চুল বিক্রি করতে এমন কোনো ঝামেলাই পোয়াতে হয় না। কিছু কিছু কারখানা মালিকেরা আবার বাড়তি লাভের আশায় নিজেরায় ঢাকায় যেয়ে চুল বিক্রি করে থাকেন।
কার্পাসডাঙ্গা চুল প্রসেসিং ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শহিদুল ইসলাম জানান, আমাদের এলাকার সকল চুল ব্যবসায়ীরা বেশ সাচ্ছন্দে কোনো ঝামেলা ছাড়াই ব্যবসা করে যাচ্ছেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে চুল ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের পুলিশি হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। যদিও আমাদের এ ব্যবসার বৈধ সনদ দেয়া হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে যখন বিভিন্ন শিল্প গড়ে তোলার জন্য ব্যাংক ঋণ নিয়ে ঋণখেলাপির মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনার জন্ম হচ্ছে একটিরপর একটি ঠিক তখনই নিজ উদ্যোগে গড়ে তোলা এ চুল প্রসেসিং কারখানা হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে সম্ভাবনার নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে।
যদি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া যায় তবে এ শিল্প সম্ভাবনার নতুন দিক উন্মোচন করতে সক্ষম হবে। শুধু তাই নয় বহির্বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যেমন চীন, কোরিয়া, আমেরিকা ইত্যাদি দেশে রেমিচুলের ব্যাপক চাহিদা থাকার কারণে এটি একটি রফতানি উপযোগী পণ্যে পরিণত হতে পারে।