মহাসিন আলী: যৌতুকের কালোথাবা কিশোরী শাপলার বাল্যবিয়ে সংসারে রূপ নিতে দেয়নি। তাই বলে থেমে থাকেনি বিধবা মায়ের যুবতী মেয়ে শাপলার সামনের দিকে এগিয়ে চলা। সততা, কৌতূহল, অধ্যাবসায় আর ইচ্ছাশক্তিতে তিনি সামনের দিকে এগিয়ে চলেছেন। বড় হওয়ার স্বপ্নে বিভোর তিনি। লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে তাকে। তিনি হয়ে উঠেছেন অসহায় নারীদের পথ চলার অনুপ্রেরণা।
শাপলা এখন যুবতী। তার ভালো নাম মরিয়ম খাতুন। বয়স প্রায় ২২ বছর। তিনি মেহেরপুর শহরের উপকণ্ঠ খন্দকারপাড়ার মরহুম মুছা শেখের এক ছেলে ও দু মেয়ের মধ্যে ছোট। ৬ বছর বয়সে মারা যান পিতা মুছা শেখ। বড়ভাই সুমন বিয়ে করে অন্যত্র সংসার পেতেছেন। বড়বোন মুসলিমা খাতুন বিয়ের পরে স্বামীর সংসার নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন। অন্যের করুনায় ভগ্নপ্রায় একটি বাড়িতে শাপলাকে নিয়ে বাস করতে থাকলেন অসহায় বিধবা মা আনজুয়ারা খাতুন।
বিধবা মা আনজুয়ারা খাতুন ছোট্ট মেয়ে শাপলাকে অন্যের প্ররোচণায় ২০০৫ সালে ৩০ ডিসেম্বর বিয়ে দেন। শাপলা তখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। স্বামীর ঘরে যেতে না যেতে যৌতুকের কারণেশারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় স্কুলছাত্রী শাপলাকে। মাত্র ১৫ দিনের মাথায় স্বামী-সংসারের গণ্ডি থেকে বের হয়ে আসেন শাপলা। মায়ের কাছে শেখেন কাপড় কাটা ও মেশিনে সেলাইয়ের কাজ। বেশি দিন থাকতে হয়নি বিধবা মায়ের ঘাড়ের বোঝা। মা-মেয়ে দুজনেই করেন সেলাইয়ের কাজ। এতে চলে যায় তাদের খাওয়া-পরা।
বড় হওয়ার স্বপ্নে বিভোর শাপলার লেখা-পড়া কয়েক বছর বন্ধ থাকায় তিনি বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মেহেরপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ টিউটোরিয়েল কেন্দ্র পরিচালিত এসএসসি প্রোগ্রামে ভর্তি হন। তিনি এসএসসিতে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। বর্তমানে তিনি মেহেরপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক (ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা শাখার) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। প্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষ মহা. আখতারুজ্জামান বলেন, শাপলা দরিদ্র ও মেধাবী। তাই তাকে উপবৃত্তির আওতায় আনা হয়েছে। এছাড়া পাঠ্য বই প্রদানসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা প্রতিষ্ঠান থেকে তাকে দেয়া হয়। কলেজের সহযোগী অধ্যাপক রওশন আরা ও প্রভাষক কামরুজ্জামান বলেন, শাপলা লেখা-পড়ায় ভালো। সামনের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় সে ভালো রেজাল্ট করবে বলে আমরা মনে করি। কৃষ্ণা, মেরিনা, পপি ও কামনা বলেন সহপাঠী হিসেবে শাপলার সকলের কাছে গ্রহণ যোগ্যতা রয়েছে।
খন্দকারপাড়া গ্রামে শাপলাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, একটি ভাঙা ঘরের বারান্দায় বসে মা-মেয়ে ছিট কাপড় কাটা ও সেলাইয়ের কাজ করছেন। শাপলা জানালেন সামনে ঈদ। তাই হাতে কাজের চাপ অনেক বেশি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রোজার ছুটি আছে। তাই দিন-রাত খেটে ঈদের আগে হাতের কাজ শেষ করা সম্ভব হবে।
শাপলার মা আনজুয়ারা খাতুন জানালেন, মেহেরপুর সদর উপজেলার আমঝুপি ইউনিয়নের টেংগারমাঠ গ্রামে তার বিয়ে হয়। বিয়ের কয়েক বছর পরে স্বামীর সাথে স্বামীর মায়ের দ্বিতীয় সংসার খন্দকারপাড়া গ্রামে আসেন। কিছুদিন পরে মেহেরপুর জেলা জজ আদালতের সাবেক পিপি অ্যাড. খন্দকার একরামুল হক হীরা তাদেরকে তার বাড়িতে থাকতে দিয়ে তিনি শহর কেন্দ্রিক হন। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে ওই বাড়িতে তিন ছেলে-মেয়ে বড় হয়েছে। ছেলে ও বড় মেয়ে বিয়ে করে অন্যত্র সংসার করছে। বাড়ির ছাদ ভেঙে পড়ে গেছে। মাটির একটি খুপরি ঘর করে মেয়েকে নিয়ে বসবাস করছি। স্বামী মুছা শেখে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৫ বছর আগে। অন্যের প্ররোচণায় শাপলার বাল্যবিয়ে দিয়েছিলাম। যৌতুক দাবির মুখে সে সংসার তার মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে ভেঙে গেছে। শাপলা বড় হয়েছে। সে সব কিছু বুঝতে শিখেছে। সে এখন বিয়েতে বসতে চায়না। প্রথমে সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। পুঁজির অভাবে সেলাই কাজ সম্প্রসারণ করতে পারছি না। সরকারি-বেসরকারি এককালীন কোনো অনুদান পাওয়া গেলে সেলাই কাজের পাশাপাশি ছিটকাপড় বিক্রি করে লাভের মাত্রা বাড়ানো সম্ভব হতো।
স্কুলপড়ুয়া পাড়ার আমেনা ও মুন্নীসহ অনেক মেয়ে বললো, শাপলার হাতের কাজ খুবই ভালো। তাই স্কুল ড্রেসসহ সব ধরনের পোশাক তারা শাপলার কাছে তৈরি করে।শাপলা বলেন, মায়ের কাছে দর্জির কাজ শিখেছি। নিজেও কয়েকজন শিষ্য তৈরি করেছি। তাদের অনেকে এখন দর্জির কাজ করে স্বামীর সংসারে অর্থের যোগান দিচ্ছেন। তিনি আরো বললেন, খাবার জন্য যখন অন্যের মুখাপেক্ষি হতে হচ্ছেনা; তবে এখন বিয়ে কেন?বিয়েতো করেছিলাম। যৌতুকের কারণে সংসার পেলাম না। কলেজে পড়ছি। অনেক লেখাপাড়া শিখবো। চাকরি করবো। নিজের পায়ে দাঁড়াবো। মায়ের দুঃখ ঘুচাবো। নিজেদের একখণ্ড জমি কিনে বাড়ি করবো। তার পরে অন্য চিন্তা করা যাবে।