এবার জাতীয় দু নেত্রীকে সংলাপে বসার তাগিদ দিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। গত রোববার পৃথক চিঠিতে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে অবিলম্বে সংলাপে বসে উদ্ভূত রাজনৈতিক সংকট সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন। চিঠিতে তিনি বলেছেন, সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে; বাংলাদেশের জনগণ একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায়, যা জাতিসংঘেরও প্রত্যাশা। স্মরণ করা যেতে পারে, গত মার্চ মাসে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনও একই ধরনের চিঠিতে দু নেত্রীকে সংলাপে বসে রাজনৈতিক সংকট সমাধানের আহ্বান জানিয়েছিলেন। ওই সময় চিঠিতে তিনি বলেছিলেন, জাতিসংঘ বাংলাদেশে সবদলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায়। দ্বিতীয় দফায় বান কি মুন মাত্র কয়েকদিন আগে দু নেত্রীকে সরাসরি টেলিফোন করে আলোচনায় বসার অনুরোধ জানিয়েছেন। শুধু বান কি মুন অথবা জন কেরি নন, বস্তুত বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশি কূটনীতিকরাও দু শীর্ষ নেত্রীকে সংলাপে বসে সমঝোতার তাগিদ দিয়ে আসছেন ক্রমাগতভাবে। কিন্তু দু বড় দলের মধ্যকার সম্পর্কের বরফ গলছে না কোনোভাবেই। বরং অতি সম্প্রতি দু বড় দলের নেতাদের কথাবার্তায় বরফ আরও জমাট বাঁধছে।
প্রশ্ন হলো- দু দলের নেতারা নিজেরাই যদি নির্বাচনের ব্যাপারে যার যার অবস্থানে অটল থাকেন, তাহলে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ বা মধ্যস্থতায় আদৌ কোনো ফল মিলবে কি? এ ব্যাপারে আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতাই এ প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ১৯৯৬ সালে দেশে প্রায় একই রকম রাজনৈতিক সংকট বিরাজ করছিলো। সে সময় মধ্যস্থতার জন্য এসেছিলেন কমনওয়েলথের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টিফেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার মধ্যে একটি আপস-মীমাংসার চেষ্টা করেছিলেন স্টিফেন। সবাই জানেন, তার সে মিশন ব্যর্থ হয়েছিলেন।
বস্তুত বিদেশিদের মাধ্যমে আমাদের নিজেদের বিরোধ-মীমাংসার চেষ্টায় কখনও ইতিবাচক ফল মেলেনি। বরং প্রতিবার নির্বাচন নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি করে নেতারা বিদেশিদের আমাদের রাজনীতিতে অযাচিতভাবে নাক গলানোর যে সুযোগ করে দেন, দেশবাসী কখনও তা ভালো চোখে দেখে না। আমাদের সমস্যা আমাদেরই সমাধান করতে হবে। সেটা সম্ভব না হলে তা আমাদের নেতাদের একটি ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচিত হবে। তবে এটিও মনে রাখা দরকার, আমাদের দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে তা প্রতিবেশী রাষ্ট্রসহ আশপাশের দেশগুলোরও উদ্বেগের কারণ হতে পারে। এ কারণে তারাও চায় বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকুক। দুঃখজনক হলো- আমাদের দেশের পরিস্থিতি নিয়ে বিদেশিরা উদ্বিগ্ন হলেও এদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এ ব্যাপারে মোটেও বিচলিত দেখা যায় না। তাদের একপক্ষ দৃশ্যত ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং অন্যপক্ষ ক্ষমতায় যাওয়ার কৌশল নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন। বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। অথচ সে ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো লক্ষণ এখন পর্যন্ত স্পষ্ট হচ্ছে না। আমাদের কথা হলো- দেশে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রের স্বার্থে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজনটি হওয়া দরকার সমঝোতার ভিত্তিতেই। একটি সংলাপ বা আলোচনার মাধ্যমে এ সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এজন্য ভাঙতে হবে অযৌক্তিক অনমনীয়তা। দু’পক্ষের অনমনীয়তার কারণে ইতিমধ্যেই অনেক ক্ষতি হয়েছে দেশের। এ পরিস্থিতি থেকে জাতি পরিত্রাণ চায়। নির্বাচনের আর কয়েক মাস মাত্র বাকি। এর মধ্যে একটি অর্থবহ সংলাপ আয়োজনের জোর চেষ্টা চালাতে হবে সরকারকে। প্রধানমন্ত্রী আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে যে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, তা বিরোধীদল যেহেতু প্রত্যাখ্যান করেছে, সেহেতু নতুন করে ভাবতে হবে নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে।