বিষধর সাপে বিষপ্রয়োগে দংশিত রোগীকে যে ওঝা কবিরাজ বাঁচাতেই পারে না, তারা মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করবে! এটাও এ সমাজের মানুষ বিশ্বাস করেছে। বিশ্বাসের খেসারত অবশ্য মৃতদেহের ওপরই পড়েছে। ঝলসে দেয়া হয়েছে। ঝাড়ফুঁকের নামে হরেক রকম নাটকে কি মৃত ব্যক্তিকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে? কখনো কি হয়? হয়, চিকিৎসক মৃত বলে ঘোষণা দেয়ার পরও কেউ কেউ বেঁচেছে এবং সুস্থ হয়ে উঠেছেন। কীভাবে? যে চিকিৎসক তাকে মৃত বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি কর্তব্যে গাফিলতি করেছেন। এটা নানাভাবেই পরীক্ষিত। মৃত ব্যক্তিকে বিজ্ঞান যুগেও বিজ্ঞান বাঁচাতে পারে না, আর সেকেলে সেই কুসংস্কারাচ্ছন্ন ঝাড়ফুঁক? হাস্যকর। হাত চালান দিয়ে যদির ওপর ভর করে সনাতন পদ্ধতিতে কাটা-ছেঁড়া করে, গাছ বেঁধে, বেটে খাইয়ে রোগী সুস্থ করার নাটক করে। বিষধর নয়, অথবা বিষ প্রয়োগ করেনি এরকম রোগী পেয়ে বাঁচানোর দাবিদার হয়ে ওই অপচিকিৎসা জিইয়ে রেখেছে তারা। স্বাস্থ্য বিভাগের দায় এড়ানো, প্রাণিসম্পদ বিভাগের অপ্রতুলতাসহ উদাসীনতায় শুধু অপমৃত্যুই বাড়ছে না, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সমাজ-পরিবেশ।
অবশ্যই এক সময় সর্পদংশিত প্রায় সকল রোগীকেই ওঁঝা কবিরাজের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। কিছু সুস্থ হয়েছে, কিছু মারা গেছে। এটা এখনও হয়। কারণ, সকল সাপ বিষধর নয়। বিষধর সাপে দংশন করলেও অনেক সময়ই বিষ প্রয়োগ করতে পারে না। ওঁঝা কবিরাজের নামে যারা অপচিকিৎসার শিক্ষা নিয়েছেন, যারা তন্ত্রমন্ত্রে অন্ধবিশ্বাসী তাদের ক’জনই আর চরম বাস্তবটা জানতে পেরেছেন? যারা বুঝেছেন ঝাড়ফুঁক এবং কেটেছেটে রক্ত বের করে বিষধর সাপে কাটা রোগী বাঁচানো যায় না, তারা ঠিকই কালবিলম্ব না করে রোগী হাসপাতালে নেয়ার সুপরামর্শটাই দেন। আর যারা জানেন না, জেনেও সামান্য কিছু টাকার লোভে ‘যদি’র ওপর ভর করে অপচিকিৎসা করেন তাদের বাস্তব জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করতে হবে। বোঝাতে হবে, হাত চালান দিয়ে বিষ প্রয়োগ করেছে না করেনি- তা নিশ্চিত হওয়া যায় না। হতেও পারে, নাও পারে। এরকম অবস্থায় আর যাই হোক, মানুষের জীবন-মৃত্যু নিয়ে মেতে ওঠা সভ্য সমাজে মানায় না। উচিতও নয়। বিষধর সাপে দংশন করলে দ্রুত বাঁধন দিয়ে, যতোটা দ্রুত সম্ভব সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে নিতে হয়। অবশ্য সকল স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই এন্টিস্নেক ভেনম নামের ইনজেকশন থাকে না, থাকলেও আবার দায়িত্ব এড়ানোর জন্য অজুহাত দাঁড় করিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেন। এ ধরনের অনিয়ম এক সময় চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে পরিলক্ষিত হলেও কয়েক বছর ধরে চিকিৎসকদের দায়িত্বশীলতা এলাকাবাসীকে আশান্বিত করেছে। বহু প্রাণ রক্ষাও পেয়েছে। এ সুসংবাদের কারণে পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর সাপে কাটা রোগী চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নিয়ে সুস্থ করে বাড়ি ফেরানোর খবরও মাঝে মাঝে পত্রস্থ হয়। এ সুসংবাদ যে সমাজের সর্বস্তরে এখনও পৌঁছেনি, তা হলে সাপে দংশিত রোগীর মৃত্যু এবং মৃত্যুর ১০ ঘণ্টা পর লাশ নিয়ে অপচিকিৎসার নাটক হতো না। একদিন হবে না। যেমন, সাপে কেটে মারা যাওয়া লাশ নদীতে ভাসানো হয় না। বীণবাদককে ডেকে নাগ-নাগিনিকে ডেকে বিষ ফেরানোর উৎসবের আয়োজন হয় না।
মেহেরপুর গাংনীর ছাতিয়ানে সাপে কেটে মারা যাওয়া লাশ নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে নাটক হয়েছে। পুলিশ বাধা দেয়নি। এলাকার প্রাণিসম্পদ বিভাগের কোনো ব্যক্তিও বন্যপ্রাণি নিয়ে এলাকাবাসীকে সচেতন করার মতো পদক্ষেপ নেয়নি। সাপ উপকারী নাকি ক্ষতিকর? এটা প্রাণিসম্পদ বিভাগেরই জানানোর দায়িত্ব। তা যখন জানায় না, সাপে কেটে মানুষ মরে ওঁঝা কবিরাজের অপচিকিৎসার কারণে বারবার তাই যখন প্রচারিত হয়- তখন সাপ নিধনের মহোৎসব প্রবণতা তো ছড়াবেই। ছড়াচ্ছেও। অথচ প্রতিবেশী দেশে? সাপে কেটে একজন মারা গেলে এলাকার স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বশীলকে উপযুক্ত কৈফিয়ত দিতে হয়। সর্প দংশনে কেউ মারা গেলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণও দেয় প্রাণিসম্পদ বিভাগ। পাশাপাশি দেশ, ভাষাও অভিন্ন। প্রায় একই আবহওয়া। ওরা পারছে, আমরা পারছি না। আমাদের পারতে হবে। স্বাস্থ্য বিভাগের জবাবদিহিতার পাশাপাশি সচেতনমহলকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল হতে হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সমাজের লাভ-ক্ষতি খতিয়ে দেখে সুদূর প্রসারী পদক্ষেপ নিতে পারাটাই তো সুন্দরের পথকে সুগম করা।