গাংনীর ছাতিয়ানে সাপে কাটা রোগী নিয়ে কথিত ওঁঝার প্রতারণা দেখলো হাজারো উৎসুক জনতা

 

গাংনী প্রতিনিধি:ওঁঝারা সাধারণ মানুষকে কীভাবে বোকা বানায় তা আবারো প্রমাণ মিললো মেহেরপুর গাংনী উপজেলার ছাতিয়ান গ্রামে। সর্প দংশনে কাঠমিস্ত্রি কামরুল ইসলামের (৪০) মৃত্যুর ১০ ঘণ্টা পর তাকে বাঁচাতে অবিশ্বাস্য আশার বাণী নিয়ে হাজির হন কথিত ওঁঝা আজিল হোসেন। মধ্যযুগীয় কায়দায় মৃতদেহ আগুনে ঝলসে জীবিত করার চেষ্টা অবশেষে কথিত ওঁঝাদের স্বভাব সুলভ কার্যকলাপের অংশ হিসেবেই ব্যর্থ হলো। হাজারো মানুষের সামনে ফন্দি-ফিকির করেও আজিলের কোনোবুজরুকি কাজে আসিনি। অন্যদিকে বিষধর সাপের সন্ধানে মাটি খুঁড়তে গিয়ে কামরুলের অসহায় স্ত্রী-সন্তানদের মাথা গোঁজার ঠাঁই মাটির ঘরটিও ভেঙে ফেলা হয়েছে।

সরোজমিনে কামরুলের বাড়িতে পৌঁছে শোনা গেলো ফতাইপুর গ্রামের মৃত বাদল মণ্ডলের ছেলে কবিরাজ আজিল হকের মরা মানুষ জীবিত করার অসংখ্য মহাগুণের কথা। তবে তা প্রমাণিত নয়। এর আগে সাপের কামড়ে মৃত কয়েকজনকে তিনি জীবিত করেছেন। এমনকি সাপের কামড়ে মৃত্যুর তিনদিন পরেও ফতাইপুর গ্রামের একজনকে জীবিত করেছেন যিনি আছেন এই আসরে। এমন আজগুবি অপপ্রচার উপস্থিত সকলের মুখে মুখে সরব। মানুষের ভিড় ঠেলে কাছে গিয়ে চোখে পড়লো গা শিউরে ওঠার মতো দৃশ্য।

কবিরাজ আজিল হক ঘটনাস্থলে পৌঁছে প্রথমে মৃতদেহের পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে বাঁচানো সম্ভব বলে দাবি করেন। কিন্তু তার আগেই কামরুলের কাফন পরানো হয়েছিলো। তার কথামতো মৃতদেহ থেকে কাফনের কাপড় খুলে লুঙ্গি পরিয়ে ২০-২৫ মিনিট লেপ দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। লাশ উঁচুতে রেখে কাঠ জ্বালিয়ে ধুপ ছিটিয়ে লাশ আগুনে ঝলসানোর জন্য প্রায় ২০ মিনিট তাপ দেয়া হয়। কথিত কবিরাজ আজিলের নির্দেশে মৃতদেহ লেপে জড়ানো অবস্থায় হাতদিয়ে ঘোরাতে থাকেন স্থানীয় ৭/৮জন। এতেও কোনো ফল না পেয়ে এবারে ৭/৮ জন মিলে লেপের ওপর ঝাঁকুনি দিতে থাকে মৃতদেহটিকে। আগুনের তাপে ইতোমধ্যেই মৃতদেহের বিভিন্ন স্থান ঝলসে গেছে। হঠাত আজিলের মুখে শোনা গেলো ৮০ ভাগ বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে কামরুলের নাক-মুখ দিয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, আরো জোরে ঝাঁকুনি দিতে হবে। কিছুক্ষণ পর মৃতদেহের মুখ ও মাথা পরীক্ষা করে আজিল ১০ মিনিট সময় চাইলেন স্থানীয় মানুষের কাছে।

কবিরাজের এই ফন্দি-ফিকিরের তামাসা উৎসুক জনতা বুঝতে না পারলেও বুঝতে পারছিলেন কামরুলের পরিবারের সদস্যরা। আশা ছেড়ে দিয়েছেন তারা অনেক আগেই। এদিকে মৃত মানুষ জীবিত করার প্রচেষ্টার খবরে গ্রাম ছাড়াও আশেপাশের কয়েকটি গ্রামের হাজারো মানুষের ভিড় জমে ঘটনাস্থলে। সকলের চোখ মৃত ব্যক্তির দিকে। কখন কবিরাজ তাকে জীবিত করবে এমন প্রত্যাশায়। কিন্তু সবাইকে নিরাশ করে কবিরাজ নীরবে ঘটনাস্থল ছাড়লেন কোনো প্রকার বাগবিতণ্ডাছাড়াই। বললেন আগে খবর পেলে বাঁচানো যেতো। কথিত কবিরাজের এই ফিকিরি সাধারণ মানুষ বুঝতে না পারলেও সচেতন কিছু মানুষের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ভণ্ডামি করে অর্থ উর্পাজনের লক্ষ্যে এ অমানবিক কার্যকলাপের বিচার দাবি করলেন স্থানীয় কিছু মানুষ। দিনে দিনে সরল সোজা মানুষের ফাঁন্দে ফেলে কথিত ওঁঝাদের এ বিবেক বিবর্জিত কর্মকাণ্ড নাড়া দিয়েছে বিবেকবান মানুষের হৃদয়ে। এলাকার সচেতনমহলে এ ঘটনার তীব্র নিন্দা, প্রতিবাদ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে ফন্দি-ফিকিরি বন্ধের দাবি জানানো হয়। হতভাগা কামরুলের মতো মরার পরেও কারো এমন পরিণতি যেন না হয়।

স্থানীয় কয়েকজন আরো জানান, এ কর্মকাণ্ড মুসলমানদের শরিয়াবিরোধী। শিরক ও গুনাহর কাজ। কেননা মৃত মানুষকে কবিরাব কিংবা ওঁঝা বাঁচাতে পারে এ কথা বিশ্বাস করাও মহাপাপ। উৎসুক আলাউদ্দিন কবীর পিন্টু কবিরাজের নানা তৎপরতা দেখে বলেন, শুনেছি মরার ওপর খাড়ার ঘা। কোনো দিন চোখে দেখেনি। আজ দেখলাম।

এদিকে কামরুলকে দংশন করা সাপটি মারতে এলাকাবাসী কামরুলের ঘরের মেঝে খুঁড়তে থাকেন। এক পযার্য়ে ঘরের টিনের ছাউনি খুলে ও মাটির দেয়াল ভেঙে ফেলা হয়। কিন্তু সাপের দেখা মেলেনি। কামরুলের বড় ছেলে মাহফুজ জানান, একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তার বাবা। তাকে হারানোর সাথে সাথে হারাতে হলো মাথা গোঁজার ঠাঁই মাটির ঘরটিও। এখন কোথায় থাকবো আমরা? কান্নায় ভেঙে পড়ে মাহফুজ।

স্থানীয়সূত্রে জানা গেছে, ছাতিয়ান গ্রামের শেখপাড়ার আইতাল আলীর ছেলে কাঠমিস্ত্রি কামরুল ইসলামের হাতে গতকাল বৃস্পতিবার ভোরে নিজ ঘরে ঘুমন্ত অবস্থায় বিষধর সাপে কামড় দেয়। পরিবারের লোকজন তাকে মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে নেয়ার পথে বামন্দী নামক স্থানে পৌঁছুলে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

নিহতের পারিবারিক পরিচয়:কামরুলের ৪ ছেলে-মেয়ের মধ্যে বড় মাহফুজ (১৪) আইসক্রিম বিক্রেতা। ছোট ছেলে জিহাদ ৫ম শ্রেণির ছাত্র। ছোট ছেলে রিয়াদ (৫) এবং সবার ছোট মেয়ে মরিয়মের বয়স আড়াই বছর। অবুঝ চার ছেলে-মেয়েকে নিয়ে অথৈ সাগরে পড়েছেন কামরুলের স্ত্রী।