স্টাফ রিপোর্টার:সোনা ও মানুষ পাচারের খবর আসে। কিছু সোনা আটক হয়,কিছু মানুষ হত্যা হয়।দুটোই সুলভ! তবে সোনার চাইতে লাশের খবরের আকর্ষণ বেশি। অসাধারণ মানুষ হলেএকজনের মৃত্যুই যথেষ্ট। জাতি লোম খাড়া করে খবর পড়বে,শুনবে,দেখবে।মিডিয়া ও অনলাইন ফোরামগুলো আলাপে-বিলাপে সরগরম হবে। সাধারণ মানুষের হত্যারবেলায় নামের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে সংখ্যা। নারায়ণগঞ্জে একসাথে ৭ জনকেহত্যার পর লাশের কারবারের সংখ্যার মানদণ্ড এখন অনেক হাই। তাই চোরাপথেমালয়েশিয়া যেতে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে মাত্র পাঁচজনের মৃত্যু কিংবা মিরপুরেবিহারিপল্লিতে ১০ জনের পুড়ে ছাই হওয়ার ঘটনাও যেন গা–সওয়া৷ গরিব মানুষেরশ্রম ও প্রাণ দুটোই অতি সুলভ মধ্য আয়ের পথযাত্রী বাংলাদেশে।
পৃথিবীর আরকোথাও গরিব মানুষ তার শেষ সম্বল বেচাবিক্রি করে টাকাপয়সা দিয়ে দাস হতেচায় না। কিন্তু বাংলাদেশিদের অনেকের স্বপ্ন সেটাই। মধ্যযুগে ইউরোপেরবলশালী ধুরন্ধরেরা আফ্রিকার স্বাধীনচেতা মানুষদের ধরে-বেঁধে দাস বানাত।মানুষ কেনাবেচা চলতো। আবার আমাদের মতো দেশে গরিব ঋণখেলাপিদের দাসত্বে বাধ্যকরা হতো। পলাশী যুদ্ধের কিছু আগের এরকম এক দাসত্ববরণের দলিলে বিবা নামের একনারী বলছে,‘আমি বিবা নান্মী দাসী,অন্ন পহতি,কর্জ পহতি তোমার সহিতআত্মবিক্রয় হইলাম’(প্রাক-পলাশী বাংলাসুবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)।বেচারি টাকা ধার নিয়েছিলো,চাল ধার নিয়েছিলো। সেই ঋণ শোধ করতে না পেরে,অতএব,স্বামী-পুত্রসমেত মহাজনের বাড়িতে দাসত্ব খাটতে হয়েছিলো।
তবেইউরোপ-আমেরিকার মতো নিষ্ঠুর দাসব্যবস্থা বঙ্গদেশে কোনো দিনই ছিলো না। আর এখনযা আছে তা তীব্র অর্থনৈতিক চাপ। এমনই চাপ যে লোকে টাকাপয়সা খরচ করেঅমানবিক শর্তে অভিবাসী হতে গিয়ে জীবন হারানোর ঝুঁকি নিতেও রাজি। ছয় বছরেপ্রবাস থেকে এসেছে ১৪ হাজার অভিবাসী শ্রমিকের লাশ (দেশের একটি জাতীয় দৈনিকের হিসাবে মতে)। দেশের মধ্যে জীবন গেছে কতো হাজারের,তার সঠিকপরিসংখ্যান নেই। সপ্তাহ খানেক আগে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় নেয়ার পথেপাঁচ বাংলাদেশিকে হত্যা এ রকম জীবনদানের নজির। গত ২২ মে নরসিংদীর পাঁচ যুবকক্ষুধায় অসুস্থ হয়ে পাচারকারীদের ট্রলারে মারা যায়। তাদের লাশ সমুদ্রেভাসিয়ে দেয়া হয়। এ মুহূর্তে আরও লাখ লাখ তরুণ বাংলাদেশি পাচার হওয়ারজন্য টাকাপয়সা হাতে নিয়ে তৈরি আছে। সব জেনেশুনে তারা ‘হয় দাসত্ব,নয়মৃত্যু’বলে পণ করেছে। নিয়মিতভাবে বিভিন্ন জায়গা থেকে চোরাপথেমালয়েশিয়াগামীদের আটক করার খবর আসে৷ তারা হয় দাসত্ব,নয় মৃত্যু’বলেপণ করেছে। এদের ঠেকানোর কেরামতি কোনো সরকারের জানা নেই।
সৌদি আরব ওকাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে আমাদের শ্রমিকেরা যায় কাফালা নামেরকর্মচুক্তির শর্ত মেনে। সম্প্রতি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এই চুক্তিকেআধুনিক সময়ের দাসত্বপ্রথা হিসেবে বর্ণনা করে বাতিলের দাবি তোলা হয়েছে৷আমাদের লাখ লাখ শ্রমিক এর শিকার৷ আর যারা মালয়েশিয়ায় যায়,তারাওকাফালার মতো কঠিন শর্তের নিগড়ে বাঁধা পড়ে। এর জন্য কেউ তাদের বাধ্য করছেনা৷ তারা বাধ্য হচ্ছে,কারণ দেশের মধ্যে কাজের সুযোগ যেমন কম,উপযুক্তমজুরিরও তেমনই অভাব।
জাতিসংঘসহ বিশ্বের তাবৎ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানমধ্যপ্রাচ্যের অভিবাসী শ্রমিকদের অবস্থাকে দাসত্বের সাথে তুলনা সাধেকরেনি৷ এদের অধিকার নেই,এদের হত্যায় বিচার হয় না। রোমান সাম্রাজ্যেরআইনে একধরনের মানুষকে বলা হতো হোমো সাসের৷ তারা দাস ছিলো না,কিন্তু তাদেরহত্যায় পাপ বা শাস্তি কোনোটাই হতো না৷ তাদের কোনো অধিকার ছিলো না৷বাংলাদেশের শ্রমজীবীদের অবস্থাও কি তার কাছাকাছি নয়?
বাংলাদেশেরগ্রামগঞ্জে এ দাসত্বের জাল ছড়ানো রয়েছে। যারা এই জালে ধরা দেয়,তাদেরনিয়ে যাওয়া হয় সীমান্তের ধারে,সমুদ্রের পাড়ে। তারপর সুযোগমতো তুলেদেয়া হয় কোনো মাছ ধরার ট্রলারে। ভাগ্য ভালো হলে সেই নৌযান মালয়েশিয়ায়পৌঁছায়। ভাগ্য আরও ভালো হলে সেখানকার পুলিশের চোখ এড়িয়ে তারা কোনোপামবাগানে বা কারখানায় কাজ পায়। আর খারাপ হলে তাদের ট্রলার ডুবে যায়।অথবা তাদের খেতে দেয়া হয় না। কিংবা তারা ধরা পড়ে মিয়ানমার,থাইল্যান্ডবা মালয়েশীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে। প্রতিবাদ করলে আদম বণিকেরা গুলিকরে সমুদ্রে লাশ ভাসিয়ে দেয়। ছোট জাহাজে গাদাগাদি করে রাখা এমন ৩১৮ জনবাংলাদেশি দিনের পর দিন মাঝ সমুদ্রে আহার-পানি ছাড়া আটকে রাখার প্রতিবাদকরেছিলো। দাস ব্যবসায়ীদের বার্মিজ শরিকেরা তখন এদের ওপর গুলি চালায়।পাঁচজন নিহত হয় আর আহত হয় অনেকে৷
ঘটতে ঘটতে একঘেয়ে হয়ে যাওয়া এসবগল্প চলতেই থাকে,চলতেই থাকে। জাতিসংঘের হিসাবে অভিবাসী শ্রমিকেরা ছাড়াইগত ৩০ বছরে ১০ লাখের বেশি পুরুষ-নারী-শিশু।