স্টাফ রিপোর্টার:ফুটবল বিশ্বকাপে সবসময়ই কয়েকটি দেশ ফেবারিট তালিকায় থাকে- ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইতালি, জার্মানি, স্পেন। এর মধ্যে ব্রাজিল ও আজেন্টিনা যেনোবাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের কাছে বিশ্বকাপে যেনো হৃদয়ের দল হয়ে। দু দলকে সমর্থন করতে গিয়ে দু ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় পুরো দেশের প্রায় সকল ফুটবলপ্রেমী। চুয়াডাঙ্গা মেহেরপুর ও ঝিনাইদহসহ দেশের প্রায় সর্বত্রই বাড়ির ছাদে ছাদে পতাকা ওড়ানো হয়। গায়ে লেগে থাকে সবসময় জার্সি।
ফুটবল প্রেমিদের বিভক্তিএমনই রূপ নেয়, আর্জেন্টিনার আগে কোনভাবে ব্রাজিল বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিলেআর্জেন্টিনা সমর্থকরা আনন্দে উন্মাতাল হয়ে পড়ে। আর ব্রাজিলের আগেআর্জেন্টিনা বিদায় নিলে কথাই নেই; পাড়ায়, মহল্লায় রঙারঙি শুরু হয়ে যায়! এএমনই এক দেশ বাংলাদেশ, বিশ্বে একমাত্র দেশ যারা কিনা বিশ্বকাপে অংশ নানিয়েও সবচেয়ে বেশি উত্তেজনায় থাকে, আনন্দে মাতে, দল জিতলে উৎসব করে আরহারলেই হতাশায় ভোগে। খাওয়া-দাওয়া বাদ দিয়ে শুধুই নিজ দলের গুণকীর্তি হয়।সেই সবকিছুর মাঝে থাকে শুধু ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনাই। চুয়াডাঙ্গার ফুটবল প্রেমীদের যে কয়েকজনের সাথে কথা হয়েছে, তাদের কেউ হয় আজের্টিনা নয় ব্রাজিল। অবশ্য হাতে গোনা কয়েকজন রয়েছেন যারা বিভিন্ন দেশের সমর্থক বলে জানিয়েছেন। চুয়াডাঙ্গা জেলা জজ বিপ্লব গোস্বামী বললেন, ১৯৭৮ সাল থেকেই আর্জেন্টিনার সমর্থক। এখনও আছি। এবার কোন দেশ বিশ্বকাপ নেবে তা আগে বলা যাবে না। আমি আমার সমর্থিত দেশকে নিয়ে তো আশা করতেই পারি। চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক দেলোয়ার হোসাইনও আর্জেন্টিনার সমর্থক। ১৯৮৬ সালে মেরাডোনার খেলা দেখে তার দেশেরই সমর্থক হয়েছি বলে জানালেন তিনি। চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার রশীদুল হাসান অবশ্য ব্রাজিলের সমর্থক। তিনি বললেন, আমি বরাবরই ব্রাজিলের সমর্থক। চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ রহমত আলী বিশ্বাস বলেলেন, আমার পছন্দের ফুটবল টিম আর্জেন্টিনা। চুয়াডাঙ্গা পৌর মেয়র রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটন? তিনি তো ব্রাজিলের গুণমুগ্ধ ফুটবল প্রেমিক।
চুয়াডাঙ্গার ফুটবলপ্রেমীদের মাঝেও বিশ্বকাপ ফুটবলের জ্বর লেগেছে। আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল ছাড়াও অন্য দলগুলোরও সমর্থকরয়েছে। তবে সেই সমর্থনে থাকে না উন্মাদনা, থাকে না পাগল হয়ে যাওয়ার মতোকোনো আবেগ, অনুভূতি। কেবল ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা সমর্থকদের মধ্যেই এমনউত্তাল উন্মত্ততা মিলে। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার সমর্থন করে এমন দু বন্ধুরকথোকথনের মাঝেই বুঝে নেয়া যায় এ দু দলের সমর্থন বাংলাদেশের কোন মাত্রায়গিয়ে পৌঁছে।দু বন্ধুর মধ্যে অন্য আলাপের মাঝে হঠাত করেই বিশ্বকাপ ঢুকে পড়ল।আর্জেন্টিনা সমর্থন করা বন্ধু বলে বসল, ‘কে কি বলে, কে কী ভাবে, তা দেখেলাভ নেই। এবার শিরোপা ইতালি, জার্মানি, ব্রাজিল কিংবা অন্য কোন দল জিততেপারবে না।’ ব্রাজিল সমর্থন করা বন্ধু বলে উঠলো, ‘তাহলে কে জিতবেআর্জেন্টিনা?’ আর্জেন্টিনা সমর্থন করা বন্ধু মিটি মিটি হেসে বললো, ‘আমার তাবলার প্রয়োজন কী?তুই-ই তো বলে দিলি।’ ব্রাজিল সমর্থন করা বন্ধু রেগে গিয়েবললো, ‘সবসময়ই তা শোনা যায়। কিন্তু কাজের কাজ কী হয়?সেই ব্রাজিলই শিরোপাজেতে। আর্জেন্টিনা ও তার ভক্তরা তা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে আর আফসোসে পুড়ে।ব্রাজিল সবচেয়ে বেশিবার ৫ বার (১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৭০, ১৯৯৪, ২০০২ সাল)চ্যাম্পিয়ন হওয়াই তার প্রমাণ বহন করে।’
আর্জেন্টিনা সমর্থক বন্ধু বলে উঠলো, ‘আমরাও ২ বার (১৯৭৮, ১৯৮৬ সাল)চ্যাম্পিয়ন হয়েছি।’ ব্রাজিল সমর্থক বন্ধুর জবাব, ‘ব্রাজিলের চেয়ে ৩ বার কম।তাও আবার সেই যে ১৯৮৬ সালে সর্বশেষ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আর্জেন্টিনা, এরপর আরসেই সুবাস পায় না। আবার বড় বড় কথা। ১৯৯০ সালের পর তো সেমিফাইনালেই আরখেলতে পারেনি আর্জেন্টিনা।’ আর্জেন্টিনা সমর্থক বন্ধুর উচ্চৈঃস্বর, ‘দুইবাররানার্সআপ হয়েছি।’ ব্রাজিল সমর্থক বন্ধু এবার মিটি মিটি হেসে বলল, ‘আমরাওতাই।’
আর্জেন্টিনা সমর্থক বন্ধু দল থেকে ব্যক্তির দিকে কথা নিয়ে গেল, ‘আমাদেরদিয়াগো ম্যারাডোনা আছেন।’ ব্রাজিল সমর্থক বন্ধুও কলার উঁচিয়ে, ‘আমাদের পেলেআছেন’ বলে উঠলো। আর্জেন্টিনা সমর্থক বন্ধু বলল, ‘আমাদের ম্যারাডোনাবিশ্ববাসীর প্রাণের ফুটবলার। তাই তো বিংশ শতাব্দীর সেরা ফুটবলার হয়েছেন।বিশ্ববাসী তাকেই পছন্দ করেছে।’ ব্রাজিল সমর্থক বন্ধু পেলের পক্ষ নিলো, ‘পেলেও তো সেরা হয়েছে।’ আর্জেন্টিনা সমর্থক বন্ধু উত্তেজিত, ‘সে (পেলে) তোহয়েছে ফিফার কর্মকর্তা, কোচ, সাংবাদিকদের ভোট পেয়ে। বিশ্ববাসীর প্রাণের লোকতো নয়। আমাদের ম্যারাডোনার সাথে যুগ্মভাবে সেরা হয়েছে।’ দল থেকে ব্যক্তিরঝগড়া একমাত্র এ দুটি দলই করতে পারে।ধীরে ধীরে দুজনই ঝগড়ার চরম পর্যায়ের দিকে চলে যাচ্ছে। আর্জেন্টিনা সমর্থকবন্ধু বললো, ‘আমাদের লিওনেল মেসি আছে।’ ব্রাজিল সমর্থক বন্ধু বলে উঠলো, ‘আমাদের আছে নেইমার।’ আর্জেন্টিনা সমর্থক বন্ধু বললো, ‘নেইমার কী মেসিরচেয়েও বড় ফুটবলার?’ ব্রাজিল সমর্থক বন্ধু একটু নিশ্চুপ, ‘তা এই মুহূর্তেনয়। তবে হবে।’ আর্জেন্টিনা সমর্থকের মুখে হাসি। অন্তত এ স্থানে যেব্রাজিলকে পেছনে ফেলা গেল। মিটি মিটি হাসি নিয়ে যেই কিছু বলতে যাবেন, এমনসময় দু বন্ধুর ঝগড়া দেখে অন্য দলের সমর্থন করেন এমন একজন এসে দুজনকে বলল, ‘দেখ, তোমরা কী শুরু করেছ। আমি বলি। যেখানেই হোক, সাফল্যকেই সবার আগে ধরতেহয়। তর্ক করলে অনেকভাবেই করা যায়। লাতিন আমেরিকার সেরা দল ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে। তবে দিন শেষে যদি সাফল্যকে ধরা হয়, তাহলে ব্রাজিলকেইসেরা ধরতে হবে। যেহেতু সবচেয়ে বেশিবার শিরোপা জিতেছে। উরুগুয়েও (১৯৩০, ১৯৫০ সাল) দুবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। তারাও ভালো দলের তালিকাতেই আছে। ঠিকতেমনি এ মুহূর্তে মানতেই হবে, নেইমারের চেয়ে মেসিই সেরা। তার দখলে আছে টানাচারবার (২০০৯, ২০১০, ২০১১, ২০১২) ফিফার বর্ষসেরা পুরস্কার জেতার গৌরব। তবেআরেকটি কথা রয়েছে। এটাও সবাইকে মানতে হবে। খেলা হচ্ছে ব্রাজিলে। ১৯৫০সালের পর দ্বিতীয়বারের মতো ব্রাজিলে বিশ্বকাপ হবে। ৬৪ বছর পর বিশ্বকাপহচ্ছে। ’৫০ সালে ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। এবারও যদি ব্রাজিলচ্যাম্পিয়ন না হয়, নিজ দেশে শিরোপা না জিততে পারে তাহলে যে দল চ্যাম্পিয়নহবে, ধরতে হবে সেই দলই সেরা। কারও দেশ থেকে যে শিরোপা জিতে তাকেই তো সেরাধরা উচিত, তাই না?’ ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা সমর্থক বন্ধু এক সুরেই বলে উঠলেন, ‘কথা ঠিক।’
সব কথা শেষ হয়ে গেলো, ঝগড়ারও ইতি ঘটলো অথচ এরপরও ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনারসমর্থক বন্ধু বিড়বিড় করতে লাগলো। ব্রাজিল সমর্থক বন্ধু বলে উঠলো, ‘আমরাইচ্যাম্পিয়ন হব।’ আর্জেন্টিনা সমর্থক বন্ধুও বলে উঠলো, ‘শিরোপা এবার ঘরেতুলবই।’ ঠিক যেমনটি নিজ নিজ দলের পক্ষে গান গেয়ে যাচ্ছেন এডসন অরান্তোস দোনসিমেন্তো পেলে, ‘ব্রাজিলই চ্যাম্পিয়ন হবে’ ও দিয়াগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা, ‘আর্জেন্টিনা শিরোপা জিতবে।’ এ তর্কের যাত্রা বাংলাদেশে চলতেই থাকবে।বিশ্বকাপ আসলেই ব্রাজিল আর্জেন্টিনাময় যে এ দেশ।