স্টাফ রিপোর্টার: রমজানকে সামনে রেখে দাম বাড়তে শুরু করেছেনিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের। বেশ কিছু পণ্যের মূল্য ইতোমধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে। গতসপ্তাহের তুলনায় পাইকারি ও খুচরা বাজারে দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ছোলা, খোলাসয়াবিন, বিভিন্ন জাতের ডাল, চিনি ও পিয়াজের। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এরইমধ্যে প্রতি কেজি ছোলা ৫ টাকা বেশি দামে কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের। বুট, মশুরি, ডাবলি, খেসারিসহ নানা জাতের ডালের দামও কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকাবেড়েছে।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে বুধবার প্রতি কেজি ভালমানের ছোলা বিক্রিহয়েছে ৫৭ থেকে ৬০ টাকা কেজিতে। কাওরানবাজারের খুচরা ব্যবসায়ী খুরশীদ মিয়াজানান, মাত্র কয়েকদিনে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) ছোলার দাম ২শথেকে ২৫০ টাকাবেড়েছে। এ ছাড়া খেসারি ডালে ২ থেকে ৩ টাকা ও ভোল্ডার (বড় দানা) মশুরি ডালে ৫টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। তিনি জানান, রোজায় যেসব ডাল জাতীয় পণ্যের চাহিদাবেশি সেগুলোর দাম ইতিমধ্যেই বেড়ে গেছে। কম দামে আমদানি করেও ব্যবসায়ীরাবেশি দামে ছোলা বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ ক্রেতাদের। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়েরঅমদানি শাখা সূত্রে জানা গেছে, দেশে প্রতি বছর গড়ে ছোলার চাহিদা প্রায় ১লাখ ৪০ হাজার টন। এর মধ্যে প্রতি মাসে ১১ হাজার টনের চাহিদা থাকলেওশুধুমাত্র রমজানে ছোলার চাহিদা থাকে প্রায় ৬০ হাজার টন।
সূত্র জানিয়েছে, গতরমজানে টন প্রতি ছোলা ৬১০ ডলারে আমদানি হলেও এবার আমদানি ব্যয় কমে তাদাঁড়িয়েছে ৫১০ ডলারে। তারপরও খুচরা বাজারে দাম বেড়েই চলেছে। দাম বাড়ারভিন্ন ভিন্ন কারণ জানা গেছে।
তবে খুচরা বিক্রেতা ও ভোক্তারা দাবি করছেনরমজানকে সামনে রেখে ছোলার দাম বাড়ার জন্য অসৎ ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফারপ্রবণতাই মূলত দায়ী। বুধবার রহমতগঞ্জে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) ছোলার দাম ছিলো২ হাজার ৪শটাকা থেকে ২ হাজার ৫৫০ টাকা। এখানকার পাইকারি ব্যবসায়ীরাজানিয়েছেন, প্রতি বস্তা ছোলার দাম ১৫০ থেকে ২শ টাকা বেড়েছে। দাম বাড়ার কারণসম্পর্কে রহমতগঞ্জে আজাদ ট্রেডার্সের পাইকারি ডাল ব্যবসায়ী মো. শামসুদ্দিনমিয়া বলেন, গত রমজানে চাহিদার চেয়ে বেশি ছোলা এনে আমদানি মূল্যের চেয়ে কমদামে বিক্রি করে অনেক ব্যবসায়ী লোকসান গুনেছিলেন। এবার অনেক ব্যবসায়ী এধরনের ঝুঁকি নিতে চাননি। তাই আমদানি কমে যাওয়ায় ছোলার দাম কিছুটা বেড়েছে।আমদানি স্বাভাবিক হলে রোজা শুরু হলেও এ অবস্থা থাকবে না বলে জানান তিনি।
চিনিরদাম নিয়ে চলছে কারসাজি: শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, রমজানে চাহিদারচাইতে বেশি চিনির মজুদ রয়েছে। তাই দাম বাড়ার কোনোই কারণ নেই। তবে বাজার ঘুরেএর কোন সত্যতা মেলেনি। কয়েক দিন ধরে দেশে উৎপাদিত পরিশোধিত চিনি খুচরাবাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫২ টাকা। আমদানি করা সাদা চিনি বিক্রি হচ্ছে৪৫ থেকে ৪৬ টাকা। গেল সপ্তাহে উভয় মানের চিনি কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা কম ছিলো।২৫ মে শিল্প মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি রমজানে চিনির দামস্থিতিশীল রাখতে আড়তদারদের পর্যাপ্ত চিনি সরবরাহের পরামর্শ দিয়েছে। একইসাথে রমজানে চিনির সরবরাহে কোন ঘাটতি না থাকা ও মজুদ না করার বিষয়ে বৈঠকেবিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেয়া হয়। বৈঠকে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু উপস্থিতছিলেন। পরে কমিটির সদস্য এম এ মালেক সাংবাদিকদের বলেন, দেশে চাহিদারঅনুপাতে চিনির কোনো কমতি নেই। দাম বাড়া এবং মজুদেরও কোনো কারণ নেই। তিনি বলেনআসন্ন রমজানকে সামনে রেখে চিনির মজুদ না করার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়েরমাধ্যমে ব্যবসায়ীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া চিনির মূল্য না বাড়ানোরবিষয়েও আলোচনা ও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাজার ঘুরে ভোক্তা ও খুচরাবিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিল্প মন্ত্রণালয়ের এ উদ্যোগ খুবএকটা কাজে আসছে না। ভোক্তারা বলছেন রমজানকে সামনে রেখে চিনি নিয়েব্যবসায়ীদের কারসাজি এখনই শুরু হয়ে গেছে। যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়া গেলেভোক্তাদের দুর্ভোগ বাড়বে। কাওরানবাজারের লক্ষ্মীপুর জেনারেল স্টোরের আবুলকাশেম জানালেন, প্রতি বস্তা চিনিতে গত সপ্তাহের চাইতে ১৫০ টাকা পর্যন্তবেড়েছে। এজন্য খুচরা বাজারে প্রভাব পড়েছে। কেজিতে তা ৩ টাকা পর্যন্তবেড়েছে। বিভিন্ন ব্রান্ডের প্যাকেটজাত চিনির দামও কেজিতে ২ টাকা পর্যন্তবেড়েছে। রাজধানীতে চিনির পাইকারি বাজার মৌলভীবাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ীজানালেন, রমজানকে সামনে রেখে দেশে উৎপাদিত চিনির পাশাপাশি আমদানি করা চিনিরমজুদ যথেষ্ট। তবে কিছু অসাধু মিল মালিকদের কারণে চিনির বাজার অস্থির হয়েউঠেছে। মৌলভীবাজারের আরবি ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী রফিকুল ইসলাম বলেন, মিল মালিকরা চিনি বাজারে সরবরাহ করছে না। তাই দাম বেড়েছে। বাজারে চাহিদারতুলনায় পণ্য কম থাকলে দাম বেড়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। তিনি জানান, বুধবারপর্যন্ত পাইকারি প্রতি বস্তা (৫০ কেজি)) দেশে উৎপাদিত চিনি বিক্রি হয়েছে ২হাজার ২০০ টাকা। আমদানি করা চিনি বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ১০০ টাকা।
অস্থিরভোজ্যতেলের বাজার: কয়েকদিন ধরেই অস্থির ভোজ্যতেলের বাজার। বাজারে পরিশোধিতপাম ও সুপার সয়াবিন তেলের দাম নিয়ে চলছে কারসাজি। খুচরা বাজারে প্রতি কেজিপাম তেল বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। কয়েকদিন আগে এই তেলের দাম ছিল ৮০থেকে ৮৫ টাকা। এ ছাড়া খোলা সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ১০৫ থেকে ১১০ টাকা কেজি।খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দুই ধরনের ভোজ্যতেলে বিভিন্ন বাজারে প্রতিকেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা পার্থক্য রয়েছে। পাম তেল কাওরানবাজারে বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকা। মোহাম্মদপুর টাউনহল কাঁচাবাজারে বিক্রি হচ্ছে ৯৫ টাকা। খোলাসয়াবিন কাওরানবাজারে ১০৫ টাকায় বিক্রি হলেও হাতিরপুল বাজারে তা বিক্রিহচ্ছে ১১০ টাকা। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে বাড়তি দাম সম্পর্কে ভোক্তা ওখুচরা বিক্রেতারা আসন্ন রমজানকে সামনে রেখে অতি মুনাফার আশায় আমদানিকারকদেরকৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টিকে দায়ী করছেন। তাদের অভিযোগ, কিছুদিন পরই পবিত্রমাহে রমজান। এ সময় সয়াবিন ও পাম তেলের চাহিদা অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশিথাকে। রমজানকে উপলক্ষ করে ইতিমধ্যেই অসাধু ব্যবসায়ীরা তেলের মজুদ করছেন।পাম ও সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করছেন। কাওরানবাজারের সততা জেনারেলস্টোরের স্বত্বাধিকারী মজিবুর রহমান বলেন, রমজানে নিম্নবিত্ত ও খেটে খাওয়ামানুষসহ হোটেল রেস্তোরাঁগুলোতে খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের চাহিদা থাকে। অসৎব্যবসায়ীরা এ সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। তারা কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করেন। তিনিবলেন, কয়েকদিন ধরেই খোলা পাম ও সয়াবিন তেল প্রতি ড্রামে (১৮৬ কেজি) ৮শ’ থেকে ৯শ’ টাকা বেড়েছে। তাছাড়া চাহিদার তুলনায় তেলও মিলছে কম। তাইখুচরাবাজারে কেজিতে ৫ টাকা বেড়েছে। অন্যদিকে পাইকারি ও সরবরাহকারীরা আগেরচেয়ে দাম কমেছে জানিয়ে বলছেন, আমদানিকারক ও মিলমালিকরা বাজারে ভোজ্যতেলেরসরবরাহ একেবারেই কমিয়ে দিয়েছেন। কেন কমিয়েছেন সেটা তারাই ভাল বলতে পারবেন।মিল মালিকরা চাহিদার মাত্র ১০ থেকে ১২ শতাংশ তেল সরবরাহ করছেন জানিয়ে তারাবলছেন যা সরবরাহ হচ্ছে তাতে ২/৩ সপ্তাহ আগে টাকা পরিশোধ করেও মিলছে না। এইসরবরাহ সঙ্কটের কারণেই মূলত ভোজ্যতেলের বাজার অস্থির হয়ে পড়েছে। রমজানেরআগে তা আরও বাড়তে পারে বলে তাদের ধারণা। ঢাকায় খোলা সয়াবিন ও পাম তেলেরপাইকারি বাজার মৌলভীবাজারে গতকাল প্রতি মণ (৪০ কেজি) পাম তেল বিক্রি হয়েছে ৩হাজার ৮০ থেকে ৩ হাজার ১শ’ (প্রতি কেজি ৭৮) টাকা। একই বাজারে প্রতি মণ (৪০কেজি) সয়াবিন তেল পাইকারি বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৫শ’ টাকা (প্রতি কেজি ৮৮টাকা)। মৌলভীবাজারের খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের পাইকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানমেসার্স জব্বার স্টোরের ব্যবস্থাপক মো. ইয়াসিন মিয়া বলেন, কয়েকদিনের মধ্যেএক ড্রাম (১৮৬ কেজি) পাম তেলে দাম ৮৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছিল। তবে বুধবারপর্যন্ত তা অনেক কমেছে। দু-এক দিনের মধ্যে দাম অনেকটাই স্বাভাবিক হবে।
টিসিবি’রবিশেষ কার্যক্রম: এদিকে বরাবরের মতো এবারও রমজানে বিশেষ কার্যক্রম হাতেনিয়েছে টিসিবি। ইতোমধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুত করা হয়েছে। এসব পণ্যেরমধ্যে রয়েছে মসুর ডাল, চিনি, ভোজ্যতেল, খেজুর, ছোলা। তবে মজুতকৃত এসব পণ্যপ্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। টিসিবি সূত্র জানায়, তাঞ্জানিয়া থেকে নিয়ে আসাএসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে ছোলা ১৫০০ মেট্রিক টন, খেজুর ১৫ মেট্রিক টন। এগুলো১০-১২ই জুনের মধ্যে চলে আসবে। এ ছাড়া ডিলারদের সরবরাহের জন্য মসুর ডাল, চিনি, ভোজ্যতেলের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। ৩ কিস্তিতে এসব পণ্য বাজারে ছাড়াহবে। প্রথম কিস্তি যাবে রমজানের ১৫ দিন আগে। রমজানের ২য় সপ্তাহে যাবে ২য়কিস্তি। আর ৩য় কিস্তি যাবে রমজানের মাঝামাঝি। সারা দেশে টিসিবি’র নিয়োগকৃত ৩হাজার ১৮ জন ডিলারের মাধ্যমে পণ্যগুলো বিক্রি হবে। যার মধ্যে শুধুরাজধানীতেই রয়েছে ৪০০ ডিলার। এসব কাজে ব্যবহার করা হবে ১৭৪টি ট্রাক। এরমধ্যে রাজধানীতে ব্যবহার করা হবে ২৫টি। এ ছাড়া সারা দেশে পণ্য পাঠানোর জন্যচট্টগ্রামে ব্যবহার করা হবে ১০টি, অন্যান্য বিভাগীয় শহরে ৫টি করে এবং বাকিজেলাগুলোতে ২টি করে ট্রাক। টিসিবি সরবরাহকৃত এসব পণ্যের মধ্যে চিনির দামধরা হয়েছে কেজি প্রতি ৪১ টাকা, ডাল (মাঝারি দানা) ৬৭ টাকা, সোয়াবিন তেল (এসআলম ব্র্যান্ড) প্রতি লিটার ৯৯ টাকা। এ ছাড়া পুষ্টি ও ফ্রেশ ব্র্যান্ডের১/২ লিটার বোতল লিটার প্রতি দাম ১১৪ টাকা, ৫ লিটারের বোতল লিটার প্রতি দাম১১২ টাকা। টিসিবি সূত্র জানিয়েছে মূলত মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তজনগোষ্ঠীকে টার্গেট হিসেবে ধরে এসব পণ্য সরবরাহ করা হয়।