স্টাফ রিপোর্টার: দুনেতার রোষানলে পড়ে প্রাণ হারালেন ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুলহক একরাম। বড় দুটি দলের সদস্য এ দু নেতা নানা কারণে অনেক দিন ধরেইএকরামকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। এর আগে ২৩ মার্চ উপজেলানির্বাচনের আগে তাকে হত্যার জন্য তিন দফায় হামলা চালানো হয়। চতুর্থ দফায় গতমঙ্গলবার একরামকে খুন করার মধ্যদিয়ে তাদের প্রচেষ্টার সমাপ্তি ঘটে।দীর্ঘদিন পর প্রকাশ্যে রাজনৈতিক খুনের এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফেনী আবারঅশান্ত হয়ে উঠতে পারে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, স্থানীয় জনগণসহ অনেকেইএ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, অনেক দিন ধরেই এখানে সব দল সমঝোতারমাধ্যমে রাজনীতি করে আসছে। গতমঙ্গলবার এর ব্যত্যয় ঘটল। যে কারণে ফেনীতে থমথমেঅবস্থা বিরাজ করছে। সবার মধ্যে এক ধরনের আতংক বিরাজ করছে।
গতকালবুধবারএকরামের দাফন শেষে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণসম্পাদক ফেনী-২ আসনের এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারীকে কটূক্তি করে বিক্ষোভমিছিল শুরু করে। এক পর্যায়ে বিক্ষুব্ধ জনতা ফেনী-পরশুরাম সড়কে বেইলিব্রিজের প্লেট খুলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখেপুলিশও আত্মরক্ষায় পালিয়ে যায়। দীর্ঘ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা ফেনী-পরশুরাম সড়কেবিভিন্ন পয়েন্টে ভাঙচুর চালায়। এ সময় হামলাকারীদের হাতে ঢাকা থেকে বিভিন্নইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার গাড়িও হামলা ও ভাঙচুরের শিকার হয়। একরাম হত্যারপ্রতিবাদে আজ বৃহস্পতিবার সকাল-সন্ধ্যা ফুলগাজীতে হরতালের ডাক দিয়েছে উপজেলা আওয়ামীলীগ। স্থানীয় জনগণের অভিযোগ, একরামের জনপ্রিয়তায় ক্ষুব্ধ হয়ে দুটি দলের দুনেতা মিলিতভাবে তাকে খুন করে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিক বিরোধেরকারণে ফেনী অশান্ত হয়ে ওঠার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। এর আগে গত দু মাসেফেনীতে ৮টি লাশ উদ্ধার হয়েছে। কারও পরিচয় পাওয়া যায়নি। তবে প্রায় সবকটিলাশই গলাকাটা অথবা গুলিতে নিহত বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে ফেনীর পুলিশসুপার বলেন, অপরাধের ধরন বলে দিচ্ছে রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়ছে।ফেনীতে অনেকের কাছে অবৈধ অস্ত্র চলে এসেছে। তিনি বলেন, আমরা অবৈধঅস্ত্রধারীদের তালিকা তৈরি করছি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা বলেন, দীর্ঘদিন পর ফেনীতে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক খুনেরঘটনা ঘটলো। এতো দিন সব দল একটি অলিখিত সমঝোতার মাধ্যমে রাজনীতি করে আসছে। যেকারণে প্রকাশ্যে খুনের ঘটনা ঘটেনি। ফেনী যে আগের মতো আবার অশান্ত হয়ে উঠতেযাচ্ছে এগুলো তারই আলামত বলে তারা উল্লেখ করেন।
সূত্র জানিয়েছে, পেশাদারহত্যাকারী ভাড়া করে সুপরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। তার মৃত্যুনিশ্চিত করার জন্য গাড়িতে গানপাউডার ছড়িয়ে আগুন দেয়া হয়। একরাম যাতে গাড়িথেকে বের হতে না পারেন সে বিষয়টি খুনিরা কাছ থেকে নিশ্চিত করেছে। একরামুলকেসরিয়ে দিতে তার রাজনৈতিক শত্রুরা তিন কোটি টাকায় কিলার ভাড়া করে। কিলিংমিশনে অংশ নেয় ২০ জন। ফেনী ছাড়াও ঢাকা থেকে কিলার আনা হয়। পুলিশ কিলারদেরঅনেককেই শনাক্ত করেছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তাদের গ্রেফতার করছে না।জনপ্রিয় উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হককে চিরতরে সরিয়ে দিতে বিপুল অংকের এটাকার জোগান দিয়েছেন রাজনৈতিক নেতা নামধারী কতিপয় দুর্বৃত্ত। তবে এসবদুর্বৃত্তের বেশিরভাগই এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। নিহতের স্বজন, পুলিশ ওপ্রত্যক্ষদর্শীদের সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।ঘটনার পর মঙ্গলবার রাতেনিহতের বড় ভাই রেজাউল হক জসিম বাদী হয়ে ফেনী সদর থানায় মামলা দায়ের করেছেন।মামলার এজাহারে বিএনপি নেতা মাহতাব উদ্দীন চৌধুরী মিনারের নাম উল্লেখ করাহয়েছে। এর সাথে এজাহারে আরও অজ্ঞাতনামা ৩০-৩৫ জন আসামির কথা বলা হয়েছে।মামলা দায়েরের পর প্রধান আসামিকে গ্রেফতার করা না গেলেও বিভিন্ন স্থান থেকেসন্দেহভাজন হিসেবে ২৩ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এরা হলেন- লক্ষীপুরেরহেলাল, ফেনীর পাঁচগাছিয়ার, কামরুল, মমিনুল হক ও হেলাল উদ্দীন, রতনপুরেরলাবু, লক্ষ্মীপুর রামগতির তানজিল ও বদি আলম, চর জব্বারের দুলাল হোসেন, শহরের গাজী ক্রস রোডের শামীম, কাজীরবাগের সোহাগ ও সাকিল, দাঙনভূঁইয়াউপজেলার শাকিল ও আমিন আলম, জামালপুরের গনি, বিরিঞ্চির রাজিব, ইকবাল, শেখআবদুল্লাহ, দুলাল মিয়া ও ফুলগাজী উপজেলার পাঁচজন। তবে প্রকাশ্যে চাঞ্চল্যকরএ হত্যাকাণ্ডের পর পর ফেনীর পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। পুরো শহরেথমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। নিহতের পরিবারও রয়েছে নিরাপত্তাহীনতায়। নিহতেরপরিবারের সদস্যরা পুলিশের কাছে বেশ কয়েকজন সন্দেহভাজন কিলারের নাম বলেছেন।এদের গ্রেফতারের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জেলা পুলিশ সুপার পরিতোষঘোষ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একটি সূত্র সন্দেহভাজন বেশকয়েকজন কিলারের নাম বলেছেন।সূত্র জানিয়েছে, আনন্দপুর ইউপিনির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদ হোসেন চৌধুরী চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। কিন্তু নিহত উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক জাহিদ হোসেনকেসমর্থন দেননি। এ নিয়ে একরামুলের সাথে জাহিদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এরসূত্র ধরে জাহিদ হোসেন ২৩ মার্চ অনুষ্ঠিত ফুলগাজী উপজেলা নির্বাচনেএকরামুলের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বিএনপি নেতা মাহতাব উদ্দীন মিনারেরপক্ষে কাজ করেন। পুলিশের একটি সূত্র বলছে, এ হত্যাকাণ্ডে দু দলের কয়েকজননেতা অর্থের জোগান দিয়েছেন।সূত্র জানিয়েছে, গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনেফেনী-১ আসন থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন নিহত উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুলহক। কিন্তু তাকে মনোনয়ন না দিয়ে আওয়ামী লীগ থেকে প্রার্থী দেয়া হয় খায়রুলবাশার তপনকে। পরে অবশ্য এ আসনটি জাসদ নেত্রী শিরীন আখতারকে ছেড়ে দেয়া হয়।ফেনী-১ আসন থেকে মনোনয়ন না পাওয়ার পেছনে নিজাম উদ্দিন হাজারীর হাত ছিলো বলেধরে নেয়া হয়। ওদিকে ফেনী-২ আসনে মনোনয়ন নিয়ে আসেন নিজাম উদ্দিন হাজারী।নির্বাচনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি এমপিও নির্বাচিত হন। এ নিয়ে দুজনেরসম্পর্কের অবনতি ঘটে। গত ২৩ মার্চ অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে একরামচেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করতে চাইলে নিজাম উদ্দিন হাজারী একরামের বিরুদ্ধেপ্রকাশ্য অবস্থান নেন। এ নিয়ে ফেনীর দু প্রভাবশালী রাজনীতিক চরম বিরোধেজড়িয়ে পড়েন। বিরোধের অন্যতম কারণ ছিলো রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার। কারণ এমপিনিজাম উদ্দিন হাজারী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হকের হাত ধরে রাজনীতিতেএসেছিলেন। কিন্তু নিজাম উদ্দিন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হওয়ারপর জেলার বিভিন্ন কাজে হস্তক্ষেপ করছিলেন। এমনকি তিনি স্থানীয় রাজনৈতিকচেন অব কমান্ডও মানছিলেন না। এ বিরোধের আরেকটি কারণ হলো, নিজাম উদ্দিনহাজারী জালিয়াতি করে জেল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রকাশিত হয়ে যাওয়া।
সূত্র জানায়, নিজাম হাজারী ২০০০ সালে অস্ত্র মামলায় গ্রেফতার হয়ে জেলে যান।বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ দিকে তিনি উচ্চ আদালতে জালিয়াতির মাধ্যমেসাজা কম খেটেই জেল থেকে বেরিয়ে যান। এ নিয়ে একটি জাতীয় পত্রিকায় গত ১০ মেপ্রতিবেদন প্রকাশিত হলে তোলপাড় শুরু হয়। ওই প্রতিবেদনটি যে প্রতিবেদক তৈরিকরেছিলেন তার মোবাইলফোন কললিস্ট সংগ্রহ করেন নিজাম উদ্দিন হাজারী। এতেতিনি দেখতে পান ওই প্রতিবেদকের সাথে নিহত উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হকসহতার বিরোধী পক্ষের কয়েকজনের যোগাযোগ হয়েছে। এরপর থেকেই একরামুলের ওপরক্ষিপ্ত হন নিজাম উদ্দিন হাজারী। পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, একরামুল খুনহওয়ার পেছনে এটি একটি কারণ কি-না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।