অপহরণকরে একসাথে সাতজনকে খুনের পর উত্তাল নারায়ণগঞ্জ : রোববার হরতাল
স্টাফ রিপোর্টার:অপহরণকরে একসাথে ৭ জনকে খুনের পর শোকের শহর ক্ষোভের আগুনে জ্বলছে। নারায়ণগঞ্জেবৃহস্পতিবার জানাজা শেষে কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে দাফনের পর তার সমর্থকরাআবার সড়কে নামেন। পুড়িয়ে দেয়া হয় আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেনের কার্যালয়।রাতে ভাঙচুরের পর আগুন দেয়া হয় হাজি মো. ইয়াসিনের বাড়িসংলগ্ন কার্যালয়।আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর নজরুল অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডে এ দু নেতা জড়িতছিলেন বলে নিহতের পরিবারের অভিযোগ।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুলইসলাম আগে থেকেই নিজের জীবন নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন। তিনি তার সম্ভাব্য ঘাতকদেরবিষয়ে আঁচ করতে পেরেছিলেন। আর এ শঙ্কা নিয়েই নিজের নিরাপত্তা দাবি করেছিলেনস্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে। অপহরণ হওয়ার একসপ্তাহ আগে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বাসায় গিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছিলেনতিনি। বলেছিলেন, কারা তাকে খুন করার পরিকল্পনা করছে। তাদের নামও বলেছিলেন।গুম হওয়ার পর নজরুলের স্ত্রী-সন্তানরাও গিয়েছিলেন প্রতিমন্ত্রীর বাসায়।এসময় মন্ত্রী নিজেই জানিয়েছিলেন যে, নজরুল আগে তাকে জীবন শঙ্কার কথাজানিয়েছিলেন। গতকাল এ বিষয়ে নিহত নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহিদুলইসলাম বলেন, নজরুল আগেই জানতো তাকে হত্যা পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তা জানতেপেরে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কাছে গিয়েছিলো। সে গুম হওয়ার পর আমরাওগিয়েছিলাম। কান্নাকাটি করেছি। কোনো কাজ হয়নি। আমরা নজরুলকে ফিরে পেয়েছি।সরকার ফিরিয়ে দিতে পারেনি। শীতলক্ষ্যা নদী ফিরিয়ে দিয়েছে। পরিবারেরসদস্যদের কাছেও নজরুল শঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন উল্লেখ করে শহিদুল ইসলামবলেন, আমাদেরও সে বলেছে যে নূর হোসেন একটি শক্তি দিয়ে তাকে হত্যা করতেপারে।
এদিকে নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা হোসেন গতকাল হত্যাকাণ্ডের বিচারদাবি করে বলেন, হত্যাকারীরা খুবই শক্তিশালী। তারা ৭টি মানুষকেখুন করে নদীতে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু কেউ দেখেনি। কোনো আলামতও রাখেনি। যে বাযারাই এ ঘটনার সাথে জড়িত আমরা তাদের বিচার চাই।
অপহৃত ৭ জনের মধ্যে বুধবার শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ৬ জনের লাশ উদ্ধারের পর বৃহস্পতিবার সকালে বাকি লাশটিও পাওয়া যায়।এদিকে, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আগামীকাল রোববার নারায়ণগঞ্জে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে জেলা আইনজীবী সমিতি।নারায়ণগঞ্জের এ ঘটনা সারাদেশেই আলোড়ন তুলেছে। বৃহস্পতিবার মে দিবসেপ্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার জনসভায়ওগুম-গুপ্তহত্যার বিষয়টি আসে। খালেদা জিয়া এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য আওয়ামী লীগকেদায়ী করলেও তার পাল্টায় শেখ হাসিনা দুষেছেন বিএনপিকে।
গত রোববার নজরুল এবং চন্দন সরকার ছাড়াও অপহৃত হন শেখ রাসেল জাতীয়শিশু-কিশোর পরিষদের সিদ্ধিরগঞ্জ থানা কমিটির সহসভাপতি তাজুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জের ৭ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগকর্মী মনিরুজ্জামান স্বপন ও লিটন, চন্দনের গাড়িচালক মো. ইব্রাহিম এবং নজরুলের গাড়িচালক মো. জাহাঙ্গীর।তিনদিন পর বুধবার দুপুরের পর বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া ইউনিয়নের শান্তিনগরএলাকাসংলগ্ন শীতলক্ষ্যা নদীতে হাত-পা বাঁধা ৬টি লাশ ভেসে ওঠে। ওইদিন ৫টিলাশ শনাক্ত হলেও ষষ্ঠ লাশটি লিটনের বলে ধারণা করা হচ্ছিল। জাহাঙ্গীরের লাশসেদিন মেলেনি বলে জানানো হয়েছিলো। কিন্তু বৃহস্পতিবার সকাল ৭টার দিকে নদীরওই এলাকা থেকে আরেকটি লাশ তোলার পর তা লিটনের বলে শনাক্ত করেন তার স্বজনরা।
বন্দর থানার ওসি আক্তার মোর্শেদ বলেন, আগের দিন যেখান থেকে ৬ জনের লাশউদ্ধার করা হয়েছিলো, একই জায়গায় এ লাশটি পাওয়া যায়। হাত-পা বাঁধা ছিলো, ইটবেঁধে লাশটি ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিলো।সবশেষ উদ্ধার করা লাশটি লিটনের হলে মর্গে থাকা অন্য লাশটি জাহাঙ্গীরের বলেধারণা করা হচ্ছিলো। গলে যাওয়ায় নিহত কাউকেই চেনা যাচ্ছিলো না। স্বজনরাপোশাকসহ ব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিস দেখে লাশ শনাক্ত করেন।
বেলা পৌনে ১২টার দিকে সানারপাড়ের মিজমিজির পশ্চিমপাড়ার পারিবারিককবরস্থানে দাফন করা হয় ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুলকে। এর আগে বেলা১১টায় সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড় বাসস্ট্যান্ডের কাছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কেতার জানাজায় অংশ নেন হাজার হাজার মানুষ। এ সময় মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ ছিলো।জানাজা ও দাফনের পর কয়েকশ’ মানুষ শিমরাইল মোড়ে ট্রাক টার্মিনালের ভেতরেএকটি ভবনে নূর হোসেনের কার্যালয়ে হামলা চালান। এরপর আগুন ধরিয়ে দেয়া হলেকার্যালয়টি পুরোপুরি পুড়ে যায়। একই সময়ে ওই কার্যালয়ের পাশে একটি যাত্রাপ্যান্ডেলেও আগুন দেয়া হয় বলে নারায়ণগঞ্জ পুলিশের এডিসি শহিদুল ইসলামজানান।
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক এবিএম মোস্তাক জানান, আগুনেরখবর পেয়ে অগ্নিনির্বাপককর্মীরা দ্রুত গিয়ে তা নিভিয়ে ফেলেন। নূর হোসেনসিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামীলীগের সহসভাপতি। এরপর নজরুল সমর্থকরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দফায় দফায়বিক্ষোভ করেন। তারা সড়কে আগুনও জ্বালান।
সন্ধ্যার দিকে মহাসড়কে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও রাতে মিজিমিজি পশ্চিমপাড়ায়হাজি ইয়াসিনের বাড়িতে হামলা চালানো হয়। ওই সময় বাড়ির সামনে তার কার্যালয়ভাঙচুরের পর অগ্নিসংযোগ করা হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।নজরুলের এলাকার বাসিন্দা ইয়াসিন সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণসম্পাদক। বুধবার লাশ পাওয়ার পর বিক্ষুব্ধ নজরুল সমর্থকরা ঢাকা-চট্টগ্রামমহাসড়কে তার পেট্রোল পাম্পটি জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন।অপহরণের পরপরই নূর হোসেন এবং ইয়াসিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলেন নজরুলেরস্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি। মামলায় তাদের আসামিও করা হয়। সেলিনার বক্তব্যঅনুযায়ী, চলতি বছর সিটি করপোরেশনের একটি রাস্তা প্রশস্তকরণের কাজকে কেন্দ্রকরে নূর হোসেনের ফুফাতো ভাই মোবারকের সাথে নজরুলের বিরোধ ও বাকবিতণ্ডা হয়।ওই ঘটনার পর মোবারক সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় নজরুলের বিরুদ্ধে মামলা করেন। সেইমামলায় নিম্ন আদালতে হাজির হয়ে জামিন নেয়ার পরপরই নজরুল অপহৃত হন।