দেশ ভয়াবহ সঙ্কটের মধ্যে পড়বে

সংসদ বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট কর্তৃক তা প্রত্যাখ্যানের ফলে দেশে রাজনৈতিক সঙ্কট দৃশ্যত আরও ঘনীভূত হয়েছে। ১৮ দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ কাঠামোয় তথা বর্তমান সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তা প্রতিহত করা হবে বলেও ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ফলে সামনের দিনগুলোতে রাজনৈতিক সংঘাত তীব্র হওয়ার আশঙ্কা করছে দেশবাসী। যে সময় নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা প্রশ্নে সরকার ও বিরোধী লের মধ্যে সমঝোতার জন্য অপেক্ষা করছিলো মানুষ, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহল থেকে এ উদ্দেশে নানা তৎপরতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছিলো- সে সময় সচিবদের সাথে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে এমন সিদ্ধান্ত জনগণের প্রত্যাশার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সরকারপ্রধান হিসেবে তিনি সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের জন্য প্রশাসনকে দিকনির্দেশনা দিতেই পারেন। কিন্তু এর অর্থ যদি হয় সংসদ ও মন্ত্রিসভা বহাল রেখে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান, তাহলে সেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে- বিদ্যমান বাস্তবতায় এটা প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। কারণ দেশে সরকার ও বিরোধীদলের মধ্যে বিরাজ করছে চরম আস্থাহীনতার সম্পর্ক। যতোই বলা হোক, মন্ত্রিসভা কোনো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেবে না, বিরোধীদলকে তা বিশ্বাস করানো কঠিন। তাছাড়া মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য কর্তৃক প্রশাসনযন্ত্র নিয়ন্ত্রণের সংস্কৃতিও দেশে বিদ্যমান। ফলে বিরোধীদলগুলো মনে করছে, নির্বাচনে এর পুরো ফায়দা নেবে ক্ষমতাসীন দল। সেক্ষেত্রে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার ব্যাপারে বিরোধীদলের সন্দিহান হওয়াটাই স্বাভাবিক। এ আশঙ্কায় প্রধান বিরোধীদল বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলে দেশ নিশ্চিতভাবেই সংঘাতের পথে যাবে।

 

আমরা জানি, সরকার ও বিরোধীদল উভয়েরই সাংগঠনিক শক্তি বেশ মজবুত। এ দু’পক্ষ যদি শক্তি প্রদর্শনের রাজনীতি শুরু করে, তাহলে দেশ ভয়াবহ সঙ্কটের মধ্যে পড়বে। এ সঙ্কটে শুধু জানমালের ক্ষতি হবে না, ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের অর্থনীতিও। রাজনৈতিক সংঘাত-সংঘর্ষের সুযোগে কিংবা অজুহাতে তৃতীয় কোনো অগণতান্ত্রিক শক্তির উত্থানের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ-বিএনপি নির্বিশেষে দেশের রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা সঙ্কটের মধ্যে পড়বে। সবেচেয়ে উদ্বেগজনক, এর ফলে ব্যাহত হবে দেশের গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা। রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে সরকারকে এটা অনুধাবন করতে হবে।

 

আমরা মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনসংক্রান্ত ঘোষণার পরও এ সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব। এজন্য সরকারকে সদিচ্ছার প্রমাণ দিতে হবে। যেভাবেই হোক, নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য বিরোধীদলকে আস্থায় আনতে হবে। বিরোধী দলকেও মনে রাখতে হবে, রাজপথের আন্দোলনের চেয়ে টেবিলের আলোচনা অনেক বেশি কার্যকর। তবে আলোচনার উদ্যোগটা নিতে হবে সরকারকেই। জাতীয় নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে একটি সমঝোতায় আসার জন্য সেই আলোচনায় বিবদমান দু’পক্ষ অংশ নেবে- এটাই কাম্য। এ আলোচনায় শুধু আগামী নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়েই নয়, আলোচনা হতে হবে প্রতিহিংসার রাজনীতির অবসান কিভাবে ঘটানো যায় তা নিয়েও। ক্ষমতাসীনরা যে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়, তার অন্যতম কারণ প্রতিহিংসার রাজনীতি। ক্ষমতা চলে গেলে প্রতিহিংসার শিকার হতে হবে, এ আশঙ্কায় ক্ষমতাসীনরা যেনতেনভাবে ক্ষমতায় থাকার প্রয়াস পায়। সুতরাং এ ভয় কাটিয়ে উঠতে হবে রাজনীতির সব পক্ষকেই। এদেশে প্রতিহিংসার রাজনীতি অনেক হয়েছে। এ রাজনীতি মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করেছে এবং সর্বোপরি সরকারগুলোকে নির্বিঘ্নে দেশ শাসন করতে দেয়নি। গণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা হস্তান্তরেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিহিংসার রাজনীতি। আমরা আশা করবো, আগামী দিনের রাজনৈতিক যেকোনো সমস্যা ও সংকট নিরসনের উপায় হিসেবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব সংলাপ বা পারস্পরিক আলোচনাকেই বেছে নেবে। তা না হলে সংঘাত-সংঘর্ষ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সামাজিক অস্থিরতা থেকে এদেশ কখনোই মুক্ত হতে পারবে না।