স্টাফ রিপোর্টার: ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নানা ধরনের উসকানি দিয়ে ১৮ দলীয় জোটকে রাজপথে আন্দোলনে নামানোর চেষ্টা করলেও সে ফাঁদে পা দেবে না বিএনপি। হরতাল, অবরোধসহ বিভিন্ন কঠোর কর্মসূচি দিয়ে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়ে জনসমর্থন হারানোর আশঙ্কার পাশাপাশি শেষ সময়ে জোরদার আন্দোলনের জন্য শক্তি সঞ্চয় রাখতেই এপথ ধরেছে দলটি। এছাড়াও আন্দোলনে নেমে অস্থিতিশীল সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি করে যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী দেশ ও দাতাগোষ্ঠীর বিরাগভাজন হতে চাইছে না তারা।
দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা বলেন, সরকারের সাথে সমঝোতা করার জন্য শেষ সময় পর্যন্ত তারা চেষ্টা চালিয়ে যাবে। এতে দলের মাঠকর্মীদের মধ্যে কিছুটা হতাশা দেখা দেয়ার আশঙ্কা থাকলেও এ ধৈর্য পরীক্ষার ইতিবাচক ফল বিএনপিরই ঘরে উঠবে। তবে নেতাকর্মীদের কিছুটা ওয়ার্মআপ রাখতে নির্দলীয় সরকারের দাবিতে দু একদিনের হরতালসহ বিক্ষোভ, সমাবেশ মানববন্ধনসহ সাদামাটা কর্মসূচি দেয়া হতে পারে। তবে তা পুরোপুরি রাজনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, সংসদ বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের পর এখনই কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচি দিতে দল ও জোটের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বিএনপির শীর্ষ নেতাদের পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু বিএনপির হাইকমান্ড তাদের জানিয়েছেন, মাথা গরম করে এখনই কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচি দেয়া ঠিক হবে না। এছাড়া বিএনপির চেয়ারপারসনের আস্থাভাজন প্রভাবশালী নেতাও কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার পক্ষে মত দেননি। তারা চেয়ারপারসনকে বলেছেন, কৌশলে দাবি আদায় করতে হবে। সংঘাত সৃষ্টি করে দাবি আদায় করার সময় এখনো আসেনি। আপাতত নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ের চেয়ে সংসদ রেখে নির্বাচনের পরিকল্পনা ঠেকাতে হবে। সংসদ ভেঙে দেয়ার পর আন্দোলন জোরদার করলে তা অনেক বেশি কার্যকরী হবে। এজন্য নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেয়ার বিষয়টি সামনে আনতে হবে।
গত সোমবার ১৮ দলীয় জোটের মহাসচিব পর্যায়ের বৈঠকে শরিক দলগুলোর কয়েকজন মহাসচিব বিএনপিকে এখনই কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার তাগিদ দেন। কিন্তু বিএনপির এক যুগ্ম মহাসচিব জানান, আন্দোলন সফল করতে শুরু থেকে সবকিছুই বিএনপিকেই করতে হবে। এজন্য কখন কঠোর আন্দোলনে যেতে হবে, তা বিএনপিই ভালো জানে। আর আন্দোলন তো চলছেই।
বিএনপির এক সিনিয়র নেতা জানান, স্বল্প সময়েই কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় সম্ভব। দাবি আদায়ের জন্য মাসের পর মাস কঠোর কর্মসূচি দিতে হবে এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে আন্দোলন যতোই বেগবান করা হোক না কেন, তাতে সুফল পাওয়া যায় না। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ইলিয়াস আলী নিখোঁজ ইস্যুতে সরকারকে বেকায়দায় ফেলানোর মতো সর্বাত্মক আন্দোলন করতে পেরেছিলো বিএনপি। এরপরও তা সফল না হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে, সেই সময়ে সরকারের মেয়াদ ছিলো আরো অনেক দিনের। তিনি আরো বলেন, লগি বৈঠার আন্দোলনসহ ৯৬ সালে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের বেশির ভাগই সফল হয়েছিলো সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণে।
ঢাকা মহানগর বিএনপির একজন প্রভাবশালী নেতা বলেন, বিএনপিকে আন্দোলনের মাঠে নামিয়ে সংহিস পরিস্থিতির সৃষ্টি করে সরকার বিশেষ ফয়দা লুটতে চাচ্ছে। এ কারণে তাদের উত্তেজিত করতে প্রধানমন্ত্রীসহ একাধিক মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতা নানা ধরনের উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিএনপির আন্দোলনের মাঠে নামার যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু কোনো পরিস্থিতিতে এসব উসকানিকে পা দেয়া যাবে না বলে দলের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন। সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একে ফাঁকা বুলি বলে মন্তব্য করেন। আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, বিরোধীদলীয় নেতা চার বছর ধরেই আল্টিমেটাম দিয়ে যাচ্ছেন। আল্টিমেটাম খালেদা জিয়ার ফাঁকা বুলি। এসব হুমকি-ধমকিতে তারা ভয় পায় না। তার আল্টিমেটাম ৪৮ ঘণ্টায় কেন, ৪৮ মাসেও মানা হবে না। আওয়ামী লীগের আরেক উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, তিনি (খালেদা জিয়া) যে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছেন, মনে হয় সেটা বাড়াতে হবে। কারণ এর আগে বহু আল্টিমেটামের মেয়াদ তিনি বাড়িয়েছেন।
এদিকে ঈদের পর কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিয়ে বিএনপি সেখান থেকে সরে আসার পরও আওয়ামী লীগ নেতারা নানা ধরনের উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। জোরদার আন্দোলন দূরে থাক, মানববন্ধন করার মতো নেতাকর্মীও বিএনপিতে নেই বলেও কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। কিন্তু এ নিয়ে বিএনপি রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে নানা পাল্টা বক্তব্য দিলেও আন্দোলনের মাঠে পা দেয়নি।
দলের শীর্ষ নেতারা জানিয়েছেন, আসন্ন সংসদ অধিবেশন শেষ হলে সরকার কী করবে, তা দেখেই বিএনপিকে কর্মকৌশল ঠিক করতে হবে। এখন মাঠে নামলে শুধু হামলা মামলা আর নির্যাতনের শিকার হতে হবে। এ জন্য বিগত সময়ে কোন পরিস্থিতিতে আন্দোলন সফল হয়েছিল সে দিকটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এরপরও রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিচার বিশ্লেষণ করে কয়েকদিনের মধ্যেই বিএনপির নীতি নির্ধারণী ফোরামের বৈঠক আহ্বান করবেন দলের চেয়ারপারসন।
সূত্রমতে, আন্দোলনের চেয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে বিএনপি। এজন্য আন্দোলনের কর্মসূচির আড়ালে নির্বাচনের প্রচরণা চালাতে আগামী ৮ সেপ্টেম্বর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে জনসভা করবেন বিএনপি চেয়ারপারসন। সেসব জনসভায় নির্বাচনমুখী বক্তব্য রাখবেন খালেদা জিয়া। স্থানীয় পর্যায়ের সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতিও থাকবে তার বক্তব্যে। আন্দোলনের কারণে পরবর্তীতে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে যাতে সমস্যায় পড়তে না হয়, সেজন্যই এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, আন্দোলনের চেয়ে সমঝোতার মাধ্যমে যাতে সমস্যার সমাধান করা যায় সে বিষয়টিকে এখনো সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি। তাদের ধারণা দুর্বল সাংগঠনিক ভিত্তির কারণে আন্দোলন সফল নাও হতে পারে। তাই কূটনীতিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সমঝোতার উদ্যোগ আরো জোরদার করা হচ্ছে। এছাড়া ১৮ দলীয় জোটের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বৃহৎ জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টাও অব্যাহত আছে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি, অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারা, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জেএসডির সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। এছাড়া মহাজোটভুক্ত দল যারা ভাবছে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেতে পারবে না তাদেরও কাছে টানার বিভিন্ন চেষ্টা চলছে।
নির্বাচন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের পর কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিলেও আন্দোলনের ধরন জানাতে পারেনি দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আন্দোলনের কর্মকৌশল কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদের রাজনৈতিক কৌশল যথাসময়ে জানানো হবে।
এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, আন্দোলন হবে নিশ্চয়ই। তবে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিএনপি সংঘাত চায় না। সংঘাত এড়াতে সরকার নির্দলীয় ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনে কিনা_ তা শেষ পর্যন্ত দেখতে চায় বিএনপি। না হলে আন্দোলন করেই দাবি আদায় করা হবে। তিনি জানান, আন্দোলন চলছে। কঠোর হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে সরকারের ওপর। তবে এ জন্য আরো কিছু সময় লাগবে।