১৬ বছরেও অসম্পূর্ণ মুজিবনগর স্মৃতিকেন্দ্র : মন্ত্রীদের আশ্বাস অব্যাহত

মাজেদুল হক মানিক/শফি উদ্দীন: মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের শপথ স্থান মেহেরপুরের মুজিবনগরকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে নির্মাণাধীন মুজিবনগর স্মৃতিকেন্দ্রের নির্মাণকাজ ১৬ বছরেও পুরোপুরি শেষ হয়নি। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সামনে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরার প্রয়াসে নির্মীয়মাণ এ স্মৃতিকেন্দ্রের কাজ মাত্র ৫ কোটি টাকার অভাবে আটকে আছে। তবে আগের প্রতিমন্ত্রীর মতোই এবারো মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিলেন চলতি বছরের মধ্যেই কাজ সম্পন্ন হবে।

১৯৯৬ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার প্রকল্পটি হাতে নেয়। সে অনুযায়ী মেহেরপুরের ঐতিহাসিক আম্রকাননকে ঘিরে ৮০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ১৯৯৮ সালের জুলাইয়ে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ওই সময় ব্যয় ধরা হয়েছিলো ২৯ কোটি ২১ লাখ টাকা। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রল্পটির কাজ শুরু হলেও নির্মাণের দায়িত্বে ছিলো গণপূর্ত অধিদফতর। তবে নকশা ও পরিকল্পনাসহ যাবতীয় কাজের তদারকি ছিলো মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হাতে। ২০০১ সালে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও এ সময়ের মধ্যে শেষ হয়নি পুরো কাজ। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রকল্পটির ব্যয় ৪৭ কোটি ৭ লাখ টাকায় উন্নীত করে। তারপরও প্রকল্পটি অসম্পূর্ণ থাকায় অর্থের অভাবকেই দায়ী করেছে গণপূর্ত বিভাগের স্থানীয় দফতর।

মেহেরপুর গণপূর্ত অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান উল্লাহ জানান, বছর দুয়েক আগে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা স্মৃতিকেন্দ্রের কাজ পরিদর্শন করেন। কেন্দ্রটির নির্মাণ দ্রুত শেষ করা, দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে ২০টি পাবলিক টয়লেট ও টিউবওয়েল স্থাপন এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্মৃতিসংবলিত একটি ফটক নির্মাণের জন্য তারা বাজেট ও পরিকল্পনা প্রেরণের নির্দেশ দেন। ওই নির্দেশনা মতো ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে সংশ্লিষ্ট দফতরে পরিকল্পনা পাঠানো হয় গত বছর। কিন্তু আজ পর্যন্ত সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি। তাই বাকি নির্মাণকাজ শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে দিন যতোই অতিবাহিত হচ্ছে ততোই বাড়ছে নির্মাণ ব্যয়। এখন নির্মাণ কাজ শুরু হলে ৫ কোটি টাকার বেশি প্রয়োজন হবে বলেও জানান তিনি।

এদিকে গত ৪ এপ্রিল মুজিবনগর কমপ্লেক্স পরিদর্শনে আসেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক। তিনি স্মৃতিকেন্দ্রের বিভিন্ন স্থাপনা দেখেন। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চলতি বছরের মধেই নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করে দ্রুত অর্থ ছাড় করা হবে। মুজিবনগরের উন্নয়নে বর্তমান সরকারের সদিচ্ছার কথা উল্লেখ করেন তিনি।

মুজিবনগর উন্নয়ন বাস্তবায়ন ফোরামের আহ্বায়ক বাগোয়ান ইউপি চেয়ারম্যান আয়ুব হোসেন বলেন, প্রতি বছর ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবসের আসেন অনেক মন্ত্রী ও সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা। নির্মাণ কাজ দ্রুত শেষ করার প্রতিশ্রুতি দেন। এর আগেও সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এবি তাজুল ইসলাম কয়েকবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু অদ্যবধি অর্থ ছাড় হয়নি। তাই আর আশ্বাস নয় মুজিবনগর তথা মেহেরপুরবাসী বাস্তবায়ন দেখতে চায় বলে জানালেন তিনি।

স্মৃতিকেন্দ্রে বাংলাদেশের যে মানচিত্র নির্মাণ করা হয়েছে, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও ঘটনার নিদর্শন রয়েছে। মানচিত্রটিকে যুদ্ধকালীন সময়ের ১১টি সেক্টরে ভাগ করে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক ঘটনাচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু বিদ্যুত সংযোগ না থাকায় তাও দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেয়া যাচ্ছে না।

গণপূর্ত অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, মুজিবনগর স্মৃতিকেন্দ্রে নির্মিত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের মানচিত্র, মুক্তিযোদ্ধাদের আবক্ষ মূর্তিকক্ষ, মিলনায়তন, প্রশাসনিক ভবন। রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসংবলিত আরো কিছু দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা। এর মধ্যে প্রশাসনিক ভবন ও মিলনায়তনের কাজ কয়েক বছর আগে শেষ হলেও বিদ্যুত সংযোগ ও প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবে দর্শনার্থীদের জন্য তা খুলে দেয়া হয়নি।

মানচিত্রের বাইরে নির্মাণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের ম্যুরাল, ২৫ মার্চের কালরাত্রির চিত্র, পাকবাহিনীর নারী নির্যাতনের চিত্র, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠান, ১২ আনসার কর্তৃক অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান ও সেক্টর বণ্টনসহ অরোরা, নিয়াজি এবং একে খন্দকারের উপস্থিতিতে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের দৃশ্য সংবলিত ভাস্কর্য। সব মিলিয়ে মুজিবনগর দর্শনার্থীদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর হাজার হাজার দর্শনার্থী এখানে বেড়াতে আসেন। কিন্তু নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়ায় অনেকটাই হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে মেহেরপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ফরহাদ হোসেন জানান, শুধু মুজিবনগর স্মৃতিকেন্দ্রের নির্মাণ সম্পন্ন নয়। স্বাধীনতার শপথ ভূমি এ মুজিবনগরকে বিশ্বের দরবারে যথাযথভাবে উপস্থাপনের লক্ষ্যে কাজ করছে বর্তমান সরকার। এখানে স্থলবন্দর, রেললাইন ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। জেলাবাসীর জীবনমানের সার্বিক উন্নয়নে খুব শিগগিরই বেশ কিছু উন্নয়ন কাজ শুরু হবে বলে জানান তিনি।