ইলিশ বিক্রেতা বনে গেলেন অর্থোপেডিক সার্জন : দু ভাইরাভায়ের চিকিৎসা বাণিজ্য

স্টাফ রিপোর্টার: আগে ইলিশ মাছ বিক্রি করতেন, খুলনার ঘাটে ঘাটে। এখন সেই তিনিই মানুষ বাঁচানোর চিকিৎসা করেন। ড্রিল মেশিন দিয়ে দিব্যি মানুষের হাড়গোড় কেটে ছিঁড়ে ফেলেন চোখের পলকেই। এতে হাতও কাঁপে না। ভয়ও লাগে না। মানুষটা বাঁচে কিংবা মরে সেই চেতনাবোধও থাকে না। ব্যস এভাবেই চলছিলো রতনের চিকিৎসা ব্যবসা। রোজগারটা ছিলো ভালোই। অনায়াসেই চলছিলো রতনের চিকিৎসা সেবা (!) বাণিজ্য। থানা পুলিশ মাস্তান সবাইকে মাসোহারা দিয়ে নিরাপদ নির্বিঘ্নেই এতোদিন ধরে চলছিলো তার এ ব্যবসা। কিন্তু ওই যে কথায় আছেনা-চোরের দশ দিন, গৃহস্থের একদিন। প্রকৃতির এ নিয়মেই শেষমেষ ধরাটা খেলেন রতন। র‌্যাব গত শুক্রবার রাতে গভীর রাতে হানা দিয়ে বসে তার তথাকথিত চিকিৎসা কেন্দ্র-ন্যাশনাল কেয়ার জেনারেল হাসপাতালে। তাৎক্ষণিক দোষ স্বীকার করায় তাদের ৭ জনকে দেয়া হয় কারাদণ্ড। ঘণ্টাব্যাপি এ অভিযানে র‌্যাব যা দেখেছে, আর যা জেনেছে, তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য ও ভয়াবহ। চিকিৎসাসেবার নামে মানুষ যে কতোটা ভয়াবহ কাণ্ডকীর্তি করতে পারে তা না দেখা পর্যন্ত র‌্যাবও বিশ্বাস করেনি।

র‌্যাব পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এএইচএম আনোয়ার পাশা অবাক বিস্ময়ে জানালেন বিদ্যের জোর নেই। জীবনে কোনোদিন চিকিৎসাশাস্ত্র পড়বে দূরের কথা-নিজের পুরো নামটাও শুদ্ধ করে লিখতে পারছে না। নামের রতন অংশটুকু লিখতে পারলেও- কৃষ্ণটা লিখতে অক্ষম। অথচ এ ব্যক্তি কি-না দেশের অর্থোপেডিক সার্জন। মানুষকে বোকা বানিয়ে চিকিৎসা বাণিজ্য করে চলছেন মাসের পর মাস। বছরের পর বছর। তাও কি-না এ রাজধানীতে। যেখানে রয়েছে দেশের সব শীর্ষ চিকিৎসক আর সচেতন মানুষ। রয়েছে নাকের ডগায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

রতনের বিদ্যার দৌড় কতোটুকু তা জানারও অবকাশ নেই। এসএসসি কিংবা এইচএসসি কোনোটারই সনদ নেই। তবে নিজের দাবি হচেছ-অষ্টম শ্রেণি পাস। ব্যস তাতেই চলছিলো তার চিকিৎসা বাণিজ্য। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো- কোন বিবেচনায় খুলনা থেকে ঢাকায় এসে এমন একটি ক্লিনিকে সার্জারির কাজ করার চিন্তা মাথায় এলো। রতন অবলীলায় গলগলিয়ে বলে ফেললেন তার ভায়রাভাই পাইক বাবুই তাকে মাছের ব্যবসা ছেড়ে এ ক্লিনিকে টেনে এনেছেন। তারপর থেকেই শুরু সার্জারির কাজ। কাজটা তার কাছে প্রথম প্রথম জটিল মনে হতো। দিন কয়েক দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেলো। কতোটা অভ্যস্ত? জানতে চাইলে রতনের উত্তর চটজলদি-রোগীকে এনেসথেসিয়া দিয়ে অজ্ঞান করা হয়। তার পর ভাঙা হাত পায়ের হাড়ে টানা দেয়ার জন্য ফুটো করতে হয়। মুহূর্তেই ড্রিল মেশিন দিয়ে ফুটোর কাজ সারা হয়। এজন্য তেমন কোনো বিদ্যে লাগে না।

কোথায় পেলেন ড্রিল মেশিন? তাতেও সরলোক্তি-বাজারের হার্ডওয়ারের দোকান থেকে কিনে আনা হয় ড্রিল মেশিন। ম্যাজিস্ট্রেট এএইচএম জানালেন, রোগীর পায়ের হাড় ড্রিল মেশিন দিয়ে ফুটো করে টানা দেয়ার কাজটি রতনই করে থাকেন। তিনি যে ড্রিল মেশিন দিয়ে রোগীর পা ফুটো করেন, সেটি হার্ডওয়ারের দোকান থেকে কিনে এনেছেন। এর গায়ে লিখা রয়েছে ৩৫০০ আর পিএম অর্থাৎ এটি মিনিটে পঁয়ত্রিশশতবার ঘুরে। দেয়াল ফুটো করা হয় এ যন্ত্র দিয়ে। এটা দিয়েই মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণভাবে তিনি মানুষের হাড় ফুটো করেন। এতে হাড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হাড় ফুটো করার উপযুক্ত যন্ত্রের ঘূর্ণানের হার অনেক কম থাকে।

এ সময় পাইক বাবুও স্বীকার করেন রতন যখন হাড় ফুটো করেন, তার আগে তিনিই রোগীর লোকাল এনেসথেসিয়া বা চেতনানাশক ইনজেকশন প্রদান করেন। পেশাদার, দক্ষ ডাক্তার ও নার্স ছাড়া হাড় ফুটো করার কাজ করাটা শুধু জটিলই নয়-এতে প্রাণহানির আশঙ্কাও প্রবল। এসব আমলে না নিয়েই এতোদিন ধরে চলছিলো-১৬/১৪ বাবর রোডে ন্যাশনাল কেয়ার জেনারেল হাসপাতালের হাড় চিকিৎসায়।
এ ক্লিনিকের অবস্থানও উপযোগী জায়গায়। জাতীয় অর্থপেডিক হাসপাতালের (পঙ্গু হাসপাতাল) খুব কাছাকাছি। ছয়তলা ভবনের তিনতলায় এ হাসপাতালটি গড়ে তোলা হয়েছে। পঙ্গু হাসপাতাল থেকে অনায়াসে রোগী ভাগানোর সুবর্ণ সুযোগ। তার চেয়ে বেশি সুযোগ গভীর রাতের চিকিৎসায়। ক্লিনিকের বহির্দৃশ্যের চাকচিক্যই যথেষ্ট। হাসপাতাল দেখলে রোগীর মনে যথেষ্ট আস্থা জাগে।

এমন নিরাপদ পরিবেশেই নির্বিগ্নে শল্যবিদের কাজ চালিয়ে আসছিলেন দুই ভায়রাভাই পাইক বাবু ও রতন কৃষ্ণ। দুজনই খুলনার বাসিন্দা। রতন ইলিশ মাছের ব্যবসা ছেড়ে আসার আগে বার বার নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন- কোনো বিপদ আপদ হলে তাকে দেখতে হবে। পাইক বাবু কথা দিয়েছিলেন টাকা পয়সা দিয়েই সবাইকে ম্যানেজ করা হয়। কোনো বিপদ হবে না। কিন্তু কথা রাখতে পারেননি পাইক বাবু। বিপদ তাকে পেয়েই বসলো।

ধরা পড়ার পর পাইক বাবুও স্বীকার করলেন তিনিই এ ক্লিনিকের মালিক। লেখাপড়াও তার অবশ্য একটু বেশি। এসএসসি পাস। তিনি আর রতন মিলেই চালিয়ে যাচ্ছিলেন পঙ্গু রোগীর চিকিৎসা। তিনি রোগীদের এনেসথেসিয়া দেন। রতন অপারেশন করেন। রতন কৃষ্ণ পাঁচ বছর আগে খুলনায় ইলিশ মাছের ব্যবসা করতেন। ব্যবসা ছেড়ে ভায়রার ডাকে ছুটে আসেন রাজধানীতে। তারপর জুটে যায় শল্যবিদের চাকরি।

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা নিরীহ রোগীদের পঙ্গু হাসপাতালের গেট থেকেই ভুল বুঝিয়ে এ ক্লিনিকে নিয়ে আসা হয়। এজন্য রাখা হয়েছে দালাল। রোগী প্রতি যারা টাকা পায়-পাঁচশ করে। শুধু এখানেই নয়। আশপাশে গড়ে ওঠা কয়েকটি প্রাইভেট হাসপাতালেও রোগী নিয়ে আসে সংঘবদ্ধ দালালচক্র। তারা রোগীদের বোঝায়-পঙ্গু হাসপাতালের বড় ডাক্তার এসব ক্লিনিকে বসেন। আগে এখানে না দেখানো পর্যন্ত পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হওয়া যায় না। প্রথম কমিশন ৫০০ টাকা পাওয়ার পর যতো বিল হয় তার ৩০% টাকা পরিশোধের রিসিটে দালালের নাম লিখা থাকে। ক্লিনিক মালিক পাইক বাবুই ২৫/৩০ জন দালালের একটি সংঘবদ্ধ চক্র নিয়োজিত রাখেন।

রতন পাইক জানান, পঙ্গু হাসপাতালের আশেপাশে গড়ে উঠা প্রায় সব প্রাইভেট হাসপাতাল এসব দালালের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। মোস্তফা, রত্না, মজনু, মনোয়ার, বাবু, আলামিন, জাকির, শরীফ, হাজেরা, ফাতেমা, মাকসুদা, বিল্লাল, জালাল, মজো, লুৎফর, মোহর, মিজান, রানা, কল্পনা, মনিরের মা এ দালালচক্রের সদস্য।

র‌্যাব জানায়, এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো আইন না থাকায় এদের এ ধরনের প্রকাশ্য উৎপাত বন্ধ করা যাচ্ছে না। পাইক বাবু সম্পর্কে জানা যায়, এক সময় তিনি বিভিন্ন ক্লিনিকে ম্যানেজার ও পার্টনার হিসেবে কাজ করতেন। পরে তিনি নিজেই ১০ বেডের হাসপাতালের মালিক হন। কয়েক মাস আগে বর্তমান ভবনে হাসপাতালটি স্থানান্তর করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পঞ্চাশ শয্যার লাইসেন্স গ্রহণ করেন। নিয়ম অনুযায়ী এ ধরনের একটি ক্লিনিকে কমপক্ষে ১৫ জন ডাক্তার ও ৩০ জন নার্স থাকা বাধ্যতামূলক। অথচ এখানে কোনো নার্স নেই। একজন মাত্র ডাক্তার আছেন খণ্ডকালীন। জটিল কিছু অপারেশনে অনকলে ডাক্তারও আনা হয় বলে জানান পাইক। এছাড়া বাকি সময় অশিক্ষিত চাকর বাকর ও ওয়ার্ডবয়ের ওপর নির্ভরশীল। মূল্য তালিকা প্রকাশ্যে ঝুলানো বাধ্যতামূলক হলেও তার কোনো বালাই নেই। ফলে দালালের মাধ্যমে ভাগিয়ে আনা রোগীর কাছ থেকে ইচ্ছামতো বিল আদায় করা হয়। হাড় ভাঙা রোগীর অপারেশনের জন্য দেড় থেকে দু লাখ টাকা পর্যন্ত বিল করে। এমনই একজন ভুক্তভোগী জামালপুরের ফরিদ (২২) জানান, পায়ের অপারেশান বাবদ তাকে ৯০,০০০ হাজার টাকা বিলের জন্য এক মাস ধরে আটক রাখা হয়। তার মতো সিলেটের রূপ মিয়াকেও (১৮) কয়েক সপ্তা ধরে আটকে রাখা হয়। একইভাবে সুনামগঞ্জের রিপন (৩৫) অপারেশনের জন্য ১,৬০,০০০ টাকা চুক্তি করলেও এখন আরও ৬০,০০০ টাকা অতিরিক্ত দাবি করছে। নরসিংদীর রওশনকে (৩৮) এক লাখ টাকা বিল করা হয়েছে। কেন এতো বিল তা জানতে চাইলে তাকে হুমকি দেয়া হয়।

পাইক বাবু বলেন, অন্য সব খরচ বাদে অর্ধেকের বেশি লাভ থাকে। প্রতি বেডের জন্য ন্যূনতম ৮০ বর্গফুট স্থানের প্রয়োজন হলেও তিনতলায় গাদাগাদি করে ৩২টি বেড তৈরি করা হয়েছে। কম্বল, বালিশ, বেডশিট রাখার স্টোর না থাকায় নোংরা বারান্দায় ফেলে রাখা হয়েছে। এছাড়া পুরাতন এক্সরে মেশিনের আনবিক শক্তি কমিশনের ছাড়পত্র না থাকায় মাত্রাতিরিক্ত বের হয়ে শরীরে ক্যান্সার সৃষ্টি করার মতো ঝুঁকির মুখে ফেলা হয় রোগীকে।

র‌্যাব এসব অপরাধের অভিযোগে কারাদণ্ড প্রদান করে ৭ জনকে। তাদের মধ্যে বাবুল চন্দ্র পাইককে (৪২) এক বছর ও একলাখ টাকা জরিমানা, রতন কৃষ্ণ মজুমদারকে (৪৩) এক বছরের কারাদণ্ড ও ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। বাকিদের মধ্যে অন্তরা শিকদার (২৯), মো. ইমাম হাসান (২২), মো. জুয়েল মিয়া (২২), মো. মাসুম বিল্লা (২২) ও শোভা বণিককে (২৫) আর্থিক জরিমানা ও ৭ দিনের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। সে সাথে হাসপাতালটিও সিলগালা করে দেয়া হয়। আর ভুক্তভোগী রোগীদের পঙ্গু হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।

Leave a comment