জামায়াতে ইসলামীর মাও. আজিজুর রহমান চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের ভাইস চেয়ারম্যান ও বিএনপির ছালমা জাহান নির্বাচিত
দামুড়হুদা প্রতিনিধি: কেন্দ্র দখল ও জোর করে ভোট দেয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগের মধ্যদিয়ে চুয়াডাঙ্গা দামুড়হুদা উপজেলা পরিষদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী মাও. আজিজুর রহমান মোটরসাইকেল প্রতীক নিয়ে ৫৬ হাজার ৬৭২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বর্তমান চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আজাদুল ইসলাম আজাদ কাপ-পিরিচ প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৪৭ হাজার ৫৪৫ ভোট।
দামুড়হুদা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিএনপির দুজন প্রার্থীর মধ্যে সাবেক দু চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী শাহ পেয়েছেন ১৮ হাজার ৭৩ এবং অপর প্রার্থী ফজলুর রহমান পেয়েছেন ৫ হাজার ১১৮ ভোট। অপর প্রার্থী এজাজুল হক তার আনারস প্রতীকে পেয়েছেন মাত্র ৭৫ ভোট। তিনি অবশ্য প্রতীক বরাদ্দের পর নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ান। লিয়াকত আলী শাহ চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপি সমর্থিত এবং ফজলুর রহমান জেলা বিএনপি একাংশের সমর্থিত ছিলেন। অবশ্য নির্বাচনের একদিন আগে কেন্দ্রীয় দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্মমহাসচিব অ্যাড. রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত পত্রে ফজলুর রহমানকে দলীয় একক প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেয়ায় দলীয় নেতাকর্মী সমর্থকদের মধ্যে বিভ্রান্তি চরমে রূপ নেয়। সমর্থকদের অধিকাংশই বিরূপ সমালোচনা করে মুখ ফিরিয়ে নেন। গতকালের নির্বাচনে তারই প্রমাণ মিলেছে বলে মন্তব্য করেছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল। তাছাড়া আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে জোর করে কেন্দ্র দখল, ভোট কেটে প্রতীকে সিল মেরে বাকশে ঢোকানোসহ বিএনপি-জামায়াতের পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে জোর করে বের করে দেয়ার অভিযোগ ওঠে। কয়েকটি কেন্দ্রে তার নজিরও মেলে। এরপরও জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী মাও. আজিজুর রহমানের বিপুল ভোটে নির্বাচিত হওয়ার খবরে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের সারা দিনের ধারণা পাল্টে দেয়।
ভাইস চেয়ারম্যান পদেও জামায়াতে ইসলামীর সমর্থিত প্রার্থী আব্দুল কাদের টিউবওয়েল প্রতীক নিয়ে ৫০ হাজার ১২৮ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রাথী শহিদুল ইসলাম চশমা প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৪৮ হাজার ৪১২ ভোট। বিএনপির দুজন প্রার্থীর মধ্যে হাবিবুর রহমান বুলেট টিয়া পাখি প্রতীকে পেয়েছেন ১৬ হাজার ২শ ভোট। আবুল হাশেম তালা প্রতীকে পেয়েছেন ১১ হাজার ১১৪ ভোট। ভাইস চেয়ারম্যান পদেও বিএনপির দুজন প্রার্থী থাকায় কর্মী সমর্থকদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি এবং সমর্থকেরা তাদের ক্ষোভেরই বহির্প্রকাশ ঘটিয়ে জামায়াতের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছে বলে অনেকেরই অভিমত। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে দুজন প্রার্থীর মধ্যে বিএনপি সমর্থিত একক প্রার্থী ছালমা জাহান হাঁস প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৭৮ হাজার ১১৭ ভোট। আওয়ামী লীগ সমর্থিত একক প্রার্থী বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান রওশন আকবর লাইলী প্রজাপ্রতি প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৪১ হাজার ৫৬ ভোট।
চেয়ারম্যান পদে মোট ১ লাখ ৩৬ হাজার ১৫২ ভোট পোল হয়। এর মধ্যে বাতিল হয়েছে ৮ হাজার ৬৬৯ ভোট। ভাইস চেয়ারম্যান পদে মোট ভোট পোল হয় ১ লাখ ৩৫ হাজার ২৮১ ভোট। বাতিল হয়েছে ৯ হাজার ৪২৭ ভোট। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে মোট ১ লাখ ৩৪ হাজার ৯৭৪ ভোট পোল হয়। এর মধ্যে বাতিল হয়েছে ১৫ হাজার ৮০১ ভোট। ভাইস চেয়ারম্যান পদে কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল দামুড়হুদা উপজেলা কন্ট্রোলরুমে একে একে যখন আসতে থাকে তখন ভাইস চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলামের পক্ষে কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল পুনরায় মেলানোর দাবি উত্থাপিত হয়। চন্দ্রবাস কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার বেলাল হোসেন বিলম্বে কন্ট্রোলরুমে পৌঁছুনোর কারণে সাময়িক বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। ফলে বেসরাকারিভাবে ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত প্রার্থীর নাম ঘোষণায় বিলম্ব হয়।
এদিকে ভোটকেন্দ্র দখল, কর্মকর্তাদের মারধর, ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শনের মধ্যদিয়ে শনিবার চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কাপ-পিরিচ মার্কার কর্মী-সমর্থকেরা ৭৭টি মধ্যে ৩১টি কেন্দ্র দখল করে জালভোট দিয়েছে বলে প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য প্রার্থীরা অভিযোগ করেছেন। বিএনপির সমর্থিত প্রার্থী ফজলুর রহমান বিকেল ৩টায় ভোট বর্জন এবং বিদ্রোহী প্রার্থী লিয়াকত আলী শাহ বেলা ২টায় পুনরায় ভোটগ্রহণের দাবি জানান। তবে, আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আজাদুল ইসলাম আজাদ জানিয়েছেন, বিএনপির প্রার্থীরা পরাজয় নিশ্চিত জেনেই এসব কথা বলেছেন।
এজেন্টদের বের করে কেন্দ্র দখল, ভোটারদের হুমকি-ধমকি ও মারধর, জালভোট প্রদানসহ বিভিন্ন অভিযোগের মধ্যদিয়ে শনিবার দামুড়হুদায় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ চলে। উপজেলার ৭৭টি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে পুরাতন বাস্তপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নাটুদহ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কালিয়াবকরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চন্দ্রবাস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পীরপুরকুল্লা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বেশিরভাগ কেন্দ্রই আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর লোকজনেরা সকাল থেকেই দখল করে নেয়। বিশেষ করে নাটুদহ মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মশিউর রহমানকে মারধর ও ৭০টি ভোট জোর করে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ইয়াচনবীর নেতৃত্বে কেন্দ্রদখল ও জোর করে কাপ-পিরিচ প্রতীকে ভোট দেয়া হয়। এ সময় বিজিবি সদস্যরা একজনকে আটক করেন। শিবনগর কেন্দ্রে জামায়াতের মোটরসাইকেল প্রতীকের পোলিং এজেন্টকে বের করে দেয়া হয়। পুরাতন বাস্তপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজ মেম্বারের নেতৃত্বে সকাল ৯টায় কেন্দ্র দখল করে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট মোশারফ হোসেনকে বের করে দেয়া হয়। ওই কেন্দ্রে আকবর আলী (৭০) নামে জামায়াত সমর্থিত এক ভোটারকে জুতোপেটা করা হয় বলে আকবর অভিযোগ করেন। দামুড়হুদা পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের বাইরে থেকে বিএনপি ও জামায়াত ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো হয়। কালিয়াবকরি কেন্দ্র দখল করে জালভোট দেয়ার অভিযোগ ওঠে। উজিরপুর কেন্দ্রও দখল করা হয় এবং বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীর ভোটারদেরকে ভয়ভীতি দেখানো হয়। এ ব্যাপারে দামুড়হুদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদুর রহমান জানান, একাধিক কেন্দ্র থেকে এ ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে, অভিযোগ পাওয়ার সাথে সাথেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পাঠানো হয়।
ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ভোট কেন্দ্র দখলের অপচেষ্টা, মারপিট ও এজেন্ট বের করে দেয়াসহ ভোটারদের অবাধ ভোট প্রদানে বাধা দেয়ার মধ্যদিয়ে শেষ হয় দামুড়হদা উপজেলা নির্বাচন। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী আবুল হাসেমকে ছুরিকাঘাতের অপচেষ্টা করা হয়। আওয়ামী লীগ সমর্থিত কিছু উচ্ছৃঙ্খল যুবকের কারণে ভোটাররাও লাঞ্ছিত হন। তারপরও চেয়ারম্যানের আসন ছিনিয়ে নিয়েছে জামাতায় সমর্থিত প্রার্থী মাও. আজিজুর রহমান। সুষ্ঠু পরিবেশে ভোটারদের ভোটগ্রহণ নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারির কারণেই আজিজুর রহমানের মোটরসাইকেল সর্বাধিক ভোট পায়। সেইসাথে অবসান হয় এ নির্বাচনের সব জল্পনা আর কল্পনার।
উপজেলার বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র সরেজমিন পরিদর্শনে গেলে জানা যায়, ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী প্রভাষক আবুল হাসেমকে মারধরসহ ছুরিকাঘাতের চেষ্টা করা হয়। বিএনপি সমর্থিত এ ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী জানান, উপজেলার চিৎলা গ্রামের হারান মণ্ডলের ছেলে আওয়ামী লীগ কর্মী সাইদুর ও তার সাঙ্গপাঙ্গ চিৎলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভোট কেন্দ্রটি দখলের চেষ্টা করে। তাতে তিনি বাঁধ সাধলে তার ওপর চড়াও হয়ে ডেগার দিয়ে তাকে আঘাত করা হয়।