মাজেদুল হক মানিক: শুরুটা ২০০০ সালের গোড়ার দিকে। অসম্ভব, অসাধারণ এক চিন্তা শক্তি নিয়ে নামলেন দর্জি ব্যবসায়। চারদিকে তখন অনেক কথাবার্তা। নারী কি-না দোকানদারি করবেন। না চলবে না। কয়েকদিন পর গুটিয়ে নেবেন, মহিলাদের দোকান কীভাবে হতে পারে এমন আরো অনেক আলোচনা সমালোচনা। তবে হাজারো নিন্দুকের মুখে চুনকালি দিয়ে রাতের বিপরীতে লড়াই করে আজ তিনি এক সফল নারী। একজন নারী উদ্যোক্তা। তিনি আর কেউই নন। আমাদের সকলের পরিচিতি মেহেরপুরের গাংনী শহরের লেডিস টেইলার্সের সত্ত্বাধিকারী রেহেনা ইয়াছমিন লিপি। প্রবল ইচ্ছা শক্তি আর পরিশ্রম এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালো সমন্বয় থাকায় কাঁটা বেছানো পথ পাড়ি দিয়ে আজ তিনি সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন। শুধু নিজেদের জন্যই নয়, তার হাত ধরে তিন শতাধিক নারী আজ বাঁচার স্বপ্ন দেখেছেন। হয়েছেন স্বাবলম্বী।
আলাপচারিতায় জীবনের এসব কথা বলে লিপি আরো জানান, যখন শুরু করি তখন একটি মাত্র সেলাইমেশিন ছিলো মূল পুঁজি। গাংনী বাজারের আমিরুল মার্কেটের দোতলায় একটি ছোট্ট দোকান নিয়ে যাত্রা শুরু। কাপড় কাটা ও সেলাই নিজেই করতেন। রাতদিন পরিশ্রমের ফলে ‘সোনার হরিণ’ নামক সফলতা এক সময় তার হাতে ধরা দেয়। দোকানের পরিধি যেমনি বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে জনবল। আজ তার দোকানে ১৪/১৫টি সেলাইমেশিন। বর্তমানে শিক্ষানবিশসহ ১৬ জন নারী দর্জি তার দোকানে কাজ করেন। সালোয়ার-কামিজ, বোরকাসহ নারীদের পোশাক তৈরি করেন। এখন আর প্রচার লাগে না। কাজের মান দিয়েই তিনি হাজারো পোশাকপ্রেমীর হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছেন। তার দোকানে নারীদের ভিড় লেগেই থাকে। গাংনী শহরের হাসপাতালপাড়ার শাহানা আক্তার জানান, পুরুষ দর্জির কাছে কাপড় তৈরি করতে গিয়ে ইতস্তত বোধ জাগে। কিন্তু লিপি আপার কাছে মন খুলে কথা বলে পছন্দের পোশাক তৈরি করা যায়। নারী দর্জিদের কাছে পোশাক বানাতে নারীরা বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
লিপি আরো জানান, তার কাছে যারা কাজ শিখতে আসে তাদের বেশিরভাগ স্বামী পরিত্যক্তা দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। কিন্তু কাজ শেখার পর স্বামীরা ওই মেয়েদের পেছনেই ঘুর ঘুর করে। এমন ২৭ জন নারীকে তিনি কাজ শিখিয়ে স্বামীর ঘরে ফেরত দিয়েছেন। দর্জি কাজ করে ওই দম্পতিরা বেশ সুখেই আছেন। এছাড়াও শিক্ষানবিশদের উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করিয়েছেন। তাদের মধ্যে দুজন নার্স প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন স্থানীয় ক্লিনিকে চাকরি করছেন। শুধু তাই-ই নয় বেশ তার বেশ কয়েকজন ছাত্রী (শিষ্য) স্বামীর বাড়িতে গিয়ে দোকান দিয়েছেন। তারাও এখন স্বাবলম্বী।
গাংনী বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান স্বপন বলেন, প্রথম দিকে অনেক কিছুই সইতে হয়েছে। কিন্তু সব সময় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন কমিটির সদস্যরা। আমরা চাই এমন কর্মঠ নারীদের সহযোগিতা করতে। লিপির এ দৃষ্ঠান্তে বাজার কমিটির সদস্যরাও গর্বিত।
ব্যক্তিগত জীবনে তিন সন্তানের জননী রেহেনা ইয়াসমিন লিপি। স্বামী এমদাদুল হক গাংনী বাজারের আমিরুল মার্কেটের কাপড়ব্যবসায়ী। গাংনী পৌরসভাধীন চৌগাছায় বসবাস করেন। স্নাতক পাস করেও তিনি চাকরির পেছনে ছুটেননি। নারীদের কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করতেই এ পেশা বেছে নিয়েছেন বলে জানান তিনি।
অন্তর্জাতিক নারী দিবসে অসহায় ও অবহেলিত নারীদের পথিকৃত হিসেবে সেলাই দিদিমনিখ্যাত রেহেনা আক্তার লিপির এ পথচলা অবিস্বরণীয় হয়ে থাকবে বলে মনে করছেন এলাকাবাসী।